স্বাধীনতার পর আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম বিকশিত ও চর্চিত ধারা হলো মঞ্চনাটক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যসব শাখার শিল্পীদের মতোই নাট্যকর্মীরাও পালন করেছিল অগ্রণী ভূমিকা।
পরাধীনতার শিকল ভাঙার আহ্বান সবকিছুর মতোই প্রভাবিত করেছিল আমাদের মঞ্চনাটককে। কারারুদ্ধ অবস্থায় মুনীর চৌধুরী একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে মঞ্চায়নের জন্য লিখেছিলেন নাটক ‘কবর’। এ নাটকেই প্রথম উচ্চারিত হয় বিজাতীয় অত্যাচার-অবিচার রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘বহিপীর’ নাটকটিতে ক্ষমতার জন্য ধর্মের অপব্যবহার প্রতীকীভাবে তুলে ধরেন এবং ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মের নামে ভন্ডামী নুরুল মোমেন রূপকভাবে তুলে ধরেন ‘নেমেসিস’ নাটকে।
সেনাশাসক আইয়ুব আমলে রবীন্দ্রনাথকে অঘোষিতভাবে করা হয়েছিল নিষিদ্ধ। আমাদের অগ্রজ নাট্যকর্মীরা যে কতোটা প্রতিবাদী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে শাসকের চোখ রাঙানি তুচ্ছ করে ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’ এবং ‘রাজা ও রানী’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কালে প্রয়াত নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ‘কালবেলা’ নাটকে ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছাসের ধ্বংসলীলায় পাকিস্তানি সরকারের দায়িত্বহীন আচরণের প্রতি কটাক্ষ করেন। একই নাট্যকারের ‘তৃষ্ণা’ নাটকে শিয়াল ও কুমিরের লোককাহিনীর আড়ালে বলা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শোষণ এবং এই শোষণ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা।
সত্তরের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ ভেঙে নাট্যকর্মীরা পথে পথে নাটক প্রদর্শনী করেছিলেন। একাত্তরের মার্চে নাট্যকর্মীরা সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলেন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ নামে একটি প্লাটফর্ম। এই ব্যানারে সৈয়দ হাসান ইমাম, গোলাম মোস্তফা, রাজু আহমেদ, আবদুস সাত্তার , রওশন জামিল, ফখরুল ইসলাম বৈরাগী প্রমুখের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতার আহ্বান নিয়ে মঞ্চায়িত হয়ে বেশ কিছু পথনাটক। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ভোরের স্বপ্ন’ ও ‘রক্ত দিলাম স্বাধীনতার জন্য’। এই সংগঠনে সম্পৃক্ত ছিলেন প্রয়াত ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফী, শিল্পী কামরুল হাসান, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, সন্জীদা খাতুন প্রমুখ।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাট্যকর্মী। যাদের মধ্যে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ, মামুনুর রশীদ, কবির আনোয়ার প্রমুখ সরাসরি রণাঙ্গনে লড়াই করেছিলেন। সৈয়দ হাসান ইমাম,কলিম শরাফী, রনেশ দাস গুপ্ত, রামেন্দু মজুমদার এবং আরো অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের হয়ে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অগ্নিকান্ডে বসে মমতাজউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন একের পর এক নাটক। যার মধ্যে ‘স্বাধীনতার সংগ্রম’, ‘এবারের সংগ্রাম’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘বর্ণচোর’-এর নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে এসব নাটক প্রদর্শিত হয়েছে এবং বাড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এ দেশের প্রগতিশীল নাট্যকার ও নাট্যকমীরা ছিল পাকিস্তানি ঘাতকদের অন্যতম শিকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা হারাই মুনীর চৌধুরীর মতো প্রতিভাবান নাট্যকারকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই আমাদের নাট্যচর্চায় নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। যুদ্ধফেরত একদল তরুণ নিজেদের আবেগ-উদ্দীপনা আর সৃজনশীলতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নাটককে বেছে নেন। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক নাট্যচর্চার পাশাপাশি সারাদেশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন দল নাট্যান্দোলনকে বিকশিত করে তোলে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বার বার উঠে এসেছে আমাদের নাটকে। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, এসএম সোলায়মানের ‘এই দেশে এই বেশে’, মামুনুর রশীদের ‘জয়জয়ন্তী’, ফাল্গুনী হামিদের ‘হায়েনা’, অলোক বসুর ‘হনন’, আবদুল হালিম আজিজের ‘হানাদার’, কুমার প্রীতিশের ‘কথা ৭১’ প্রভৃতি। এছাড়াও সাহিত্যের নাট্যরূপ ও বিভিন্ন বিদেশী নাটকের বাংলা রূপান্তরেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। এরকম কিছু মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক হলো ‘মুখোশ’, ‘কোর্ট মার্শাল’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘একাত্তরের পালা’। তবে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগ্রামে প্রদর্শিত পথনাটকে। মঞ্চনাটকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ এসেছে খুব কমই, বেশি এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সারাদেশ সোচ্চার, এই জনমত গড়ে তুলতে আমাদের নাটকও পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দেশীয় চরিত্রগুলো যেভাবে পথনাটকে উঠে এসেছে, তা গণমানুষের মনে সঞ্চারিত করেছে ক্ষোভ ও ঘৃণা।
বাংলাদেশ সময় ১৬২০, মার্চ ২১, ২০১১