বাংলা চলচ্চিত্রের বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে প্রায় চার বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ে নায়িকা হিসেবে এসেছে অনেক মিষ্টি মুখ।
১৯২৯ সালে ঢাকায় প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দি লাস্ট কিস’ নির্মিত হয়। অবশ্য তার কিছুদিন আগে ১৯২৮ সালে ‘সুকুমারী’ নামে চার রিলের স্বল্পদৈর্ঘ্যর একটি টেস্ট ফিল্ম নির্মিত হয়। সেসময় শৈল্পিক তাগিদে ঢাকার নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী হয়েছিলেন অপেশাদারী মনোভাব নিয়ে। তাদের মধ্যে খাজা জহির, খাজা আজাদ, সৈয়দ সাহেব আলম প্রমুখের নাম স্মরণযোগ্য। সে সময় সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারনে কোনো মেয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে সম্মত হতো না। তাই পুরুষদেরই নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে হতো। এমনই একজন হলেন সৈয়দ আবদুস সোবহান। ‘সুকুমারী’ ছবিতে তিনি নারী সেজে অভিনয় করেন। এটি নওয়াব পরিবারে ঘরোয়ভাবে প্রদর্শিত হয়। এরপর নবাব পরিবারের পৃষ্টপোষকতায় নির্বাক ছবি ‘দি লাস্ট কিস’ নির্মিত হয়। ১৯৩১ সালের শেষের দিকে মুকুল টকিজে (বর্তমানে ঢাকার আজাদ সিনেমা হল) মুক্তি পেয়েছিল। রক্ষনশীল সমাজের ভদ্রঘরের মেয়েদের জন্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করাটা যেহেতু ছিল গর্হিত কাজ, তাই সে সময় নায়িকা লোলিতাকে নিয়ে আসা হয়েছিল ঢাকার বাদামতলীর পতিতালয় থেকে। মেয়েটির আসল নাম ছিল বুড়ি। ছবির নায়ক ছিলেন খাজা আজমল । চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষ হলে মেয়েটি আবার তার আগের পেশায় ফিরে যায়। একই ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অন্য দুটি মেয়ে দেবমালা ও হীরামতিকেও পতিতালয় থেকে আনা হয়।
এমনই রক্ষণশীল সামাজিক অবস্থার মধ্যে এ দেশের চলচ্চিত্রের সূচনা, কালক্রমে তা পত্র-পল্লবী-পুস্পে বিকশিত হয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় শিল্প মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। যদিও আমাদেও সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের অবস্থা খানিকটা বেহাল। তবু চলচ্চিত্রের আবেদন আজও ফুরিয়ে যায় নি।
বাংলা চলচ্চিত্রে কালের আর্বতে আমরা পেয়েছি সুমিতা, সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সূচরিতা, রোজিনা, মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাসের মত নায়িকা। আমাদের এবারের পর্বে থাকছে বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত দর্শক হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়া জনপ্রিয় নায়িকাদের কথা।
সূচনালগ্নের নায়িকারা
১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের পরই দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যায়। বাংলাদেশের খ্যাতিমান পরিচালক আবদুল জব্বার খান নিজেই এ ছবির নির্মাতা ও নায়ক ছিলেন। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন চট্টগ্রামের রঙ্গনাট্য দলের অভিনেত্রী পূনির্মা সেনগুপ্তা। সেদিনের রক্ষনশীলতাকে উপেক্ষা করে সহনায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী জহরত আরা এবং ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী পিয়ারী বেগম ওরফে নাজমা। মূলত ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পরই এদেশে ধারাবাহিকভাবে কাহিনীচিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) গঠিত হলে চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা আরও বেগবান হয়। ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ছবির মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয় সুমিতা দেবীর। সুমিতা দেবীর আসল নাম হেনা লাহিড়ী। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের বেশ কটি ছবির নায়িকা ছিলেন তিনি। এই গুণী অভিনেত্রী অভিনীত ছবির মধ্যে আছে ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘কখনো আসেনি’, ‘তানহা’,‘সংগম’,‘বেহুলা’,‘এই তো জীবন’, ‘মায়ার সংসার’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘আকাশ আর মাটি’, ‘এই দেশ তোমার আমার’ প্রভৃতি। কাছাকাছি সময়ে নায়িকা হিসেবে আতœপ্রকাশ করেন সুলতানা জামান, নাসিমা ও রওশন আরা। সুলতানা জামান অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে আছে ‘মাটির পাহাড়’, ‘অনেক দিনের চেনা’, ‘মালা’ প্রভৃতি। নাসিমা খান অভিনয় করেছেন ‘জাগো হুয়া সাবেরা’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সূর্যøান’, ‘ধারাপাত’ , ‘অর্পন’ প্রভৃতি ছবিতে। রওশন আরা অভিনয় করেন ‘সূর্যøান’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তালাশ’, ‘নদী ও নারী’ ছবিতে।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন সুচন্দা, সুজাতা, শর্মিলী আহমেদ, শবনম। ‘চেনা অচেনা’, ‘অবাঞ্চিত’, ‘প্রতিনিধি’, ‘ধারাপাত’ ও ‘১৩ নয় ফেকু ওস্তাগার লেন প্রভৃতি ছবির নায়িকা ছিলেন সুজাতা। রাজশাহীর মেয়ে মাজেদা মল্লিক চলচ্চিত্রে শর্মিলী আহমেদ নামে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার অভিনীত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘পানছি-বাওড়ি’, ‘আলিঙ্গন’, ‘পলাতক’, ‘আবির্ভাব’, ‘ঠিকানা’, ‘আগুন’ প্রভৃতি। হিন্দু ধর্মালম্বীর মেয়ে নন্দিতা বসাক ঝর্না শিশু শিল্পী হিসেবে ‘আসিয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন । পরে শবনম নামে নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে। শবনম অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কখনো আসেনি’, ‘আযান’, ‘দর্শন’ , ‘বেগানা’, ‘জোয়ারভাটা’ , ‘নাচঘর’, ‘সন্ধি’, ‘যোগাযোগ’, ‘জুলি’ প্রভৃতি। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রে সক্রিয় ছিলেন। সত্তর দশকে শবনম নায়ক রহমানের সঙ্গে গড়ে তুলেন জনপ্রিয় জুটি।
সোনালী যুগের নায়িকারা
মেধাবী নির্মাতা জহির রায়হানের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন সুচন্দা। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘কাগজের নৌকা’ ছবিতে তিনি প্রথমে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। সেখান থেকেই জহির রায়হানের নজরে পড়েন। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ‘বেহুলা’ ছবিতে সুচন্দাকে নাম ভূমিকায় কাস্ট করেন। ছবিটা ব্যবসা সফল হয়। ‘বেহুলা’তে অভিনয় করতে গিয়ে সুচন্দার সঙ্গে জহির রায়হানের মন দেয়া-নেয়া শুরু হয় এবং হঠাৎ করেই তারা বিয়ে করেন। এরপর সুচন্দা একে একে ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘আনোয়ারা’ , ‘দুই ভাই’, ‘আয়না’, ‘পিয়াসা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘অশ্র“ দিয়ে লেখা’, ‘প্রতিশোধ’, ‘জীবন সঙ্গিনী’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্তদর্শকনন্দিত জুটি ছিল রাজ্জাক-সুচন্দা । এছাড়াও সুচন্দা নায়ক খলিল, আজিম, রহমান, আনোয়ার হোসেন, উজ্জ্বলের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে কাজ করেছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে। চলচ্চিত্রে আসার আগে চট্টগ্রামের এই মিষ্টি মেয়ের আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাংলা ছবির সোনালী সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নায়িকা প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে ‘নবীতুন’ চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেছিলেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কবরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘ময়নামতি’, ‘বাহানা’, ‘চোরাবালি’, ‘মতিমহল’, ‘পরিচয়’, ‘রংবাজ’, ‘দেবদাস’, ‘সুজন সখি’, ‘কলমীলতা’ প্রভৃতি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ যাবৎকালের অন্যতম সেরা জুটি ছিল রাজ্জাক-কবরী।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকার মধ্যে অন্যতম শাবানা। মাত্র ৯ বছর বয়সে রতœা নামে ‘নতুন সুর’ ছবিতে শিশুশিল্প হিসেবে তিনি অভিনয় শুরু করেন। শিশু শিল্পী হিসেবে তাকে দেখা যায় ‘ডাকবাবু’ ও ‘তালাশ’ ছবিতেও। প্রখ্যাত নির্মাতা এহতেশামের ‘চকোরী’ ছবির মাধ্যম নায়িকা হিসেবে তার অভিষেক হয়। রতœা নাম পাল্টে রাখা হয় শাবানা। বাংলাদেশের সবধরনের ছবির নির্ভোরযোগ্য নায়িকা হিসেবে শাবানার ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এ দেশের আপামর জনসাধারণ শাবানার মাঝে কখনও মা, কখনও বউ, কখনও বা মমতাময়ী ভাবির ছায়া খুঁজে পেয়েছে। শাবানার উল্লেখ্যযোগ্য ছবি হলো ‘আনাড়ি’, ‘সমাধান’, ‘জীবনসাথী’, ‘মাটির ঘর’, ‘লুটেরা’, ‘সখি তুমি কার’, ‘কেউ কারও নয়’, ‘পুত্রবধু’, ‘আক্রোশ’, ‘ভাত দে’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’ প্রভৃতি। ঢাকার ছবিতে প্রায় ৩০ বছর ধরে শাবানা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়িকা। শাবানা নাম শুনতেই দর্শকদের উন্মাদনা শুরু হয়ে যেত। শুধুমাত্র শাবানার নামেই হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় লেগে যেত। শাবানার রুপালী জগত থেকে চলে যাওয়ার পরও এখনও হাজারো মানুষ তাকে মনে রেখেছে।
বাংলা সিনেমার আরেক সুপারস্টার হিরোইন ববিতা। আসল নাম ফরিদা আখতার আর ডাকনাম পপি। জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই বাগেরহাটে। পৈতৃক বাড়ি অবশ্য যশোরে। ১৯৬৮ সালে সিনে ওয়ার্কশপের ব্যানারে নির্মিত ‘সংসার’ ছবির মাধ্যমে প্রথমে রুপালী পর্দায় পা রাখেন। বড় বোন সুচন্দার স্বামী জহির রায়হানই তাকে চিত্রজগতে নিয়ে আসেন। জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই তার নাম ববিতা হয়ে যায়। আর নায়িকা হিসেবে তার উত্থান ঘটে ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির মাধ্যমে। ১৯৭০ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত শতাধিক ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন ববিতা বেশিরভাগ ছবিই ছিল ব্যবসা সফল। ববিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘পিচঢালা পথ’,‘স্বরলিপি’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘অশনি সংকেত’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমনি’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’,‘এতিম’, ‘তিনকন্যা’, ‘রামের সুমতি’, ‘বিরহব্যথ্যা’, ‘বিরাজ বউ’ প্রভৃতি।
ববিতা ও জাফর ইকবাল জুটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্নযুগের জনপ্রিয় ও রোমান্টিক জুটি। একসাথে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে বেশ ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। গুজব আছে তাদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ছিল। তবে পর্দায় প্রেম করে তারা সফল হলেও বাস্তবে তা হতে পারেননি। তাছাড়া ববিতা জাফর ইকবাল ছাড়া অন্য নায়কদের সাথে অভিনয় করেও সফল হয়েছেন। ফারুক, উজ্জ্বল, রাজ্জাক, সোহেল রানা, ওয়াসিম, বুলবুল আহমেদ ছিলেন ববিতার রোমান্টিক নায়ক। বাংলাদেশের আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নায়িকা হিসেবে তিনি স্বীকৃত। সত্যজিৎ রায়ের অশনী সংকেত ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয় করে ববিতা ঈর্ষনীয় সাফল্য পান। দেশে বিদেশে অর্ধশতাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন চিরসবুজ এই অভিনেত্রী।
৭০ এর দশকের আরেক আলোচিত নায়িকা হলেন অলিভিয়া। তার অভিনীত ছবিগুলো হলো ‘দি রেইন’,‘মাসুদ রানা’, ‘লুটেরা’, ‘বে-দ্বীন’, ‘চক্কও’ প্রভৃতি। তবে অলিভিয়া পরবর্তীতে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন রুপালী পর্দা থেকে।
টিনএজ ইমেজ নিয়ে রুপালী পর্দায় হাজির হয়েছিলেন একটি মিষ্টি মেয়ে। নাম বেবী হেলেন। শিশু শিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় ‘বাবুল’ ছবিতে ১৯৬৯ সালে। নায়িকা হিসেবে ১৯৭২ সালে ‘স্বীকৃতি’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। নায়িকা হিসেবে এরপর একে একে অভিনয় করলেন ‘ডাকু মনসুর’, ‘আপনজন’, ‘মা¯তান’, ‘সমাধি’, ‘আলোর পথে’, ‘গরমিল’, ‘মাটির মায়া’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘নাগরদোলা’, ‘মায়ের আঁচল’ প্রভৃতি ছবিতে। প্রায় ১০০ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সুচরিতা যখন সিনেমার নায়িকা ছিলেন তখন দলে দলে দর্শকরা সিনেমা হলে ভিড় করতেন। একে তো তার অল্প বয়স, তর উপর অসাধারণসুন্দরী; তাই সুচরিতার ছিল বিশাল ভক্তকূল। তিনি যখন নায়িকা তখন শাবানা, ববিতা, কবরী, রোজিনা, অলিভিয়া প্রমুখের সঙ্গে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। সুচরিতা সফল হয়েছিলেন বলেই তিনি আজও এত জনপ্রিয়।
আশির দশকে চলচ্চিত্রে আসা দুই আলোচিত নায়িকা হলেন রোজিনা ও অঞ্জু। রোজিনা চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৭৬ সালে ‘জানোয়ার’ ছবির মাধ্যমে। তার অভিনীত ছবিগুলো হলো ‘হারানো মানিক’, ‘রাজমহল’, ‘অভিমান’, ‘চোখের মণি’, ‘রসের বাঈদানী’, ‘সংঘর্ষ’, ‘পরদেশী’ ,‘সোহাগ মিলন’, ‘তাসের ঘর’, ‘দুলারী’, ‘আঘাত’, ‘শত্র“’ প্রভৃতি। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার মেয়ে অঞ্জু ঘোষ চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৮২ সালে ‘সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে। বলা হয়ে থাকে অনজু ঘোষই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নায়িকা যিনি ক্যামেরার সামনে খোলামেলা পোশাকে দাড়ান। আর্কষনীয় শরীর আর মোহনীয় নৃত্যে অঞ্জু ঘোষ তখন লাখো তরুণের রাতের ঘুম হারাম করেছেন। ‘বেদের মেয়ে জোৎøা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অঞ্জু রাতারাতি সুনাম অর্জন করেন। এপার-ওপার বাংলায় ছবিটি ব্যাবসা সফল হয়। রতার অভিনীত এই ছবিটিকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া অঞ্জু ঘোষ অভিনয় করেছেন ‘খেলার সাথী’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কোরবানী’, ‘সতি নাগকন্যা’, ‘আশীঁবাদ’ প্রভৃতি ছবিতে।
তৃতীয় প্রজন্মের নায়িকারা
স্বাধীনতার আগে সুমিতা-সুচন্দাদের যদি চলচ্চিত্রের প্রথম প্রজন্মের নায়িকা ধরা হয় তাহলে দ্বিতীয় প্রজন্মের নায়িকা হলেন শাবানা-ববিতারা। তাদের পরেই আসে তৃতীয় প্রজন্ম।
১৯৮৪ সালের এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম থেকে বের হয়ে আসেন নায়িকা পারভীন সুলতানা দিতি। তিনি অল্প সময়েই বেশ সুনাম অর্জন করেন। ইলিয়াস কাঞ্চন ও সোহেল চৌধুরীর সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে দিতি বেশ কিছু ভাল ছবি উপহার দেন। তিনি অভিনয় করেছেন ‘ভাই বন্ধ’ু, ‘হীরামতি’, ‘দুই জীবন’, ‘সুদ-আসল’ প্রভৃতি ছবিতে। দিতি অ্যাকশন লেডি হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেন। নব্বইয়ের দশকের পুরোটা জুড়েই দিতিকে দেখা গেছে ভিলেনদের সাথে যুদ্ধ করতে। ‘আজকের হাঙ্গামা’, ‘খুনের বদলা’, ‘লেডি ইন্সপেক্টর’, ‘পাপী শত্র“’এরকম বহু ছবিতে অ্যাকশন লেডির চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।
দুই বোন সুচন্দা ও ববিতার পথ ধরে চলচ্চিত্রে আসেন চম্পা। সুচন্দা পরিচালিত ‘তিন কন্যা’ ছবির মাধ্যমে সিনেমায় আসেন তিনি এবং জনপ্রিয়তাও পান খুবই অল্প সময়ে। তিনি অভিনয় করেন ‘নিষ্পাপ’, ‘সহযাত্রী’, ‘ভেজাচোখ’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘বিরহ ব্যথ্যা’ প্রভৃতি ছবিতে। চম্পা ঢালিউডের সিনেমায় ব্যাপক সফল নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এদেশে যে কজন হাতেগোনা শিল্পীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে চম্পা তাদের মধ্যে অন্যতম। অনেক প্রতিথযশা পরিচালকের নান্দনিক ছবিতে তিনি কাজ করে তিনি দেশের মান উজ্জ্বল করেছেন।
৮০ দশকের শেষভাগে পরিচালক এহতেশাম চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন নায়িকা শাবনাজকে। শাবনাজ বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে ‘চাঁদনী’, ‘অঞ্জলী’, ‘সাক্ষাত’, ‘ডাক্তার বাড়ি’ উল্লেখ যোগ্য। পরবর্তীতে সহঅভিনেতা নাঈমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিদায় জানিয়ে দেন রুপালী জগতকে।
এই প্রজন্মের নায়িকারা
পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে মৌসুমীকে রুপালী পর্দায় নিয়ে আসেন। শাবানা-কবরী-ববিতার প্রজন্মের পর মৌসুমী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নিজেকে নিয়ে যান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সালমান শাহ-মৌসুমী জুটিকে দর্শকরা দারুণভাবে গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তা ভেঙ্গে যায়। এরপর মৌসুমী তার নিজের মত করেই অগ্রসর হন। ওমর সানি, বাপ্পারাজ, মান্না, শাকিব খান, ফেরদৌস সবার বিপরীতে অভিনয় করেই মৌসুমী সফল। সাংসরিক জীবনেও স্বামী ওমর সানিকে নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করছেন। মৌসুমী অভিনীত জনপ্রিয় ছবির মধ্যে রয়েছে ‘দেনমোহর’, ‘গরীবের রানী’, ‘øেহ’, ‘মেহের নিগার’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘আম্মাজান’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘খাইরুন স্ন্দুরী’, ‘এক কাপ চা’, ‘প্রজাপতি’ প্রভৃতি। এছাড়াও মৌসুমি ব র্তমানে ব্যস্ত সময় আছেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে।
৯০ দশকে আরো দুই জনপ্রিয় নায়িকা বাংলা চলচ্চিত্রে পদার্পন করেন। তারা হলেন শাবনূর ও পপি। শাবনূর চলচ্চিত্রে আসেন প্রয়াত পরিচালক এহতেশাম এর হাত ধরে। শাবনূর অভিনীত প্রথম ছবি ‘চাঁদনী রাতে’। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে গড়ে ওঠা তার জুটি দর্শকদের গ্রহনযোগ্যতা পায়। শাবনুর তার যোগ্যতা ও মেধাগুনে নিজেকে ঢালিউডের এক নম্বর নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘তোমাকেই চাই’, ‘বিক্ষোভ’, ‘আনন্দ অশ্র“’, ‘রঙিন সুজন সখী’, ‘ভালবাসি তোমাকে’, ‘মন মানে না’, ‘দুই নয়নের আলো’ প্রভৃতি শাবনুরের তথা বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবি। শাবনূর সর্বাধিক ১৪টি ছবিতে সালমানের সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেছেন। ১৯৯৩ সালে ‘চাঁদনী রাতে’ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি যে পথ চলার সূচনা করেছিলেন তা এখন সাফল্যে ভরে গিয়েছে। শত ঝামেলা ও গুজবের মাঝেও একটু ভেঙ্গে পড়েন নি তিনি । তাই তো এখনও পরিচালক ও প্রযোজকরা চোখ বুঝে শাবনূরকে নিয়ে নেন তাদের ছবিতে। পপি অভিনীত আলোচিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘কুলি’, ‘দরদী’, ‘কারাগার’, ‘পাহারাদার’, ‘মায়ের স্বপ্ন’,‘জিদ্দি’, ‘মা আমার বেহেশত’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ প্রভৃতি।
৯০ এর দশকের শেষ ভাগে জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘এ জীবন তোমার আমার’ এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন চট্টগ্রামের মিষ্টি মেয়ে পূর্নিমা। অল্প সময়েই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পূর্নিমা অভিনীত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘তুমি শুধু আমার’, ‘জজ ব্যরিস্টার’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘ক্ষমতার গরম’, ‘হৃদয়ের কথা’ প্রভৃতি। মাঝখানে বিয়ে এবং সাংসরিক কাজে ব্যস্ততার জন্য অভিনয় থেকে দূরে সরে যান। এখন আবার নিয়মিত কাজ করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত নায়িকাদের মাঝে এগিয়ে আছেন অপু বিশ্বাস। আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের পর পরই একচিত্রগ্রাহকের পরমর্শে এফআই মানিকের নজরে পড়েন তিনি। তারপর এই নির্মাতার ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার বড় পর্দায় পথচলা শুরু। বর্তমানে ঢাকাই চলচ্চিত্রে এককভাবে শাকিব খানের সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। শাকিব খানকে নিয়ে প্রেম ও বিয়ের গুঞ্জন মিডিয়াতে ভেঁসে বেড়ালেও অপু বরাবরই বিষয়টা এড়িয়ে যান পেশাদারভাবে।
এছাড়াও ঢাকার চলচ্চিত্রে বেশকিছু নবাগত নায়িকার অভিষেক হয়েছে। তারাও তাদের যোগ্যতা ও ভাল কাজের মাধ্যমে প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেতে চান। নিপুন, জনা, শাকিবা, রেসি, বিন্দু, মিমো, শখ, মীম, অহনা, বর্ষা নতুন হিসেবে ভালই কাজ করছেন। তবে একথা নির্ধিদ্বায় বলে দেয়া যায় আর একজন শাবানা কিংবা ববিতা পেতে আমাদের অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময় ১৭২৫, এপ্রিল ০৩, ২০১১