বলিউড ফিল্মডোমের রঙিন ভুবন নয়, ক্রিকেট মাঠই এখন তাদের বেশি টানছে। ব্যাট-বলের প্রেমে পড়ে দলকে উৎসাহ দিতে তারা ছুটে বেড়াচ্ছেন।
এই তিন কন্যা যেন নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন আইপিএলের মহাআসরে। তেমন ক্রিকেট জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কেনো তারা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়েছেন ? শুধুই কি অর্থের প্রয়োজনে, নাকি আইপিএলকে তারা ভাবছেন গ্ল্যামার প্রদর্শনের অন্যতম প্লাটফর্ম ? ক্রিকেটের ব্যকারণ না বুঝলেও এই তিন গ্ল্যামার স্টার-ই আইপিএলের তিনটি দল নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রীতি জিনতা কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব, জুহি চাওলা কলকাতা নাইট রাইডার্স আর শিল্পা শেঠী রাজস্থান রয়্যালস; তিন কন্যা হয়ে উঠেছেন যেন নিজ নিজ দলের ব্যানার।
প্রীতি জিনতা : প্রাণ জুড়ে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব
২০০৮ সালে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবকে ৭৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেন নেস ওয়াদিয়া, মোহিত বর্মন, করণ পাল, আদিত্য খান্না এবং বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা। জনপ্রিয় কোম্পানি ডাবরের মালিক মোহিত বর্মণ, বম্বে ডায়িংয়ের প্রীতি জিনতা-নেস ওয়াদিয়া এবং অ্যাপেজে সুরেন্দ্রর মালিক করণ পাল সেই শৈশবের বন্ধু। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিংস ইলেভন পাঞ্জাব দলটি কিনে নেন। যতটা খেলার ছলে প্রীতি ঢুকে পড়েছিলেন আইপিএল-এর আঙিনায়, তার চেয়ে এখন প্রীতি অনেক বেশি সিরিয়াস। ‘কিংস ইলেভন’-এর মালিকানা পেতে তার সঙ্গে বয়ফ্রেন্ড নেস ওয়াদিয়াও একসময় টাকা ঢেলেছেন। কিন্তু স্রেফ গ্ল্যামার প্রদর্শন বা লাইম লাইটে থাকার জন্য দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি তিনি। প্রীতি যে খেলাটা নিয়ে কতটা আন্তরিক তা তার বিভিন্ন উদ্যোগেই বোঝা যায়। ‘কিংস ইলেভন’-এর যে কোনও বোর্ড মিটিংয়ে সবচেয়ে আগে তিনি কনফারেন্স রুমে হাজির থাকেন ও মিটিং শেষ হওয়ার পর সবার শেষে বের হন।
নিজের ক্রিকেট জ্ঞান খুব বেশি না থাকলেও নিজের দলের প্রতিটি খেলায় মাঠের গ্যালারিতে বসে উৎসাহ দেন খেলোয়াড়দের। এমনকি দলের বিজয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে করমর্দন শেষে বুকে জড়িয়ে নেন। মাঠে প্রীতির এমন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস অনেক ক্ষেত্রে লজ্জায় ফেলে দেয় চিয়ারলিডারদেরও। আইপিএলে জড়ানোর পর থেকে প্রীতি অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন স্পোর্টস নিউজ পড়া বা স্পোর্টস চ্যানেল সার্ফিংয়ে। নিজের এমন আইপিএল ভক্তি নিয়ে প্রীতি অকপটে বলেন, আমি যতটা না ক্রিকেটপ্রেমী তার চেয়ে ঢের বেশি আইপিএলের ফ্যান।
শাহরুখের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই গলায়-গলায় হোক না কেন, শুরুর আইপিএল থেকেই শাহরুখকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি প্রীতি। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে বাগিয়ে নিতে শাহরুখ-জুহির সঙ্গে দড়ি টানাটানির খেলায় প্রীতি মেতে উঠেছেলেন। এমনকি শাহরুখ-জুহি নামি মিউজিশিয়ান বিশাল শেখরকে দিয়ে টিমের থিম সঙ করালে প্রীতি টেনে এনেছেন সাজিদ-ওয়াজিদের মতো আরেক সেলিব্রিটি মিউজিশিয়নকে, গান গাইয়েছেন ভাঙড়া কিং দালাল মেহন্দিকে দিয়ে।
শুধুমাত্র আইপিএলের কারণে গত দু’বছর বলিউড কিংবা বিনোদন জগতে প্রায় অনুপস্থিত ছিলেন প্রীতি জিনতা। প্রীতি ভক্তরা টোলপড়া গালের মোহনীয় হাসির প্রিয় অভিনেত্রীকে রূপালী পর্দায় বেশ কিছুদিন দেখতে না পেলেও মাঠে সেই সুহাসিনী প্রীতিকে ঠিকই পেয়েছেন।
এবারের আইপিএল শুরুর আগে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের খেলা নিয়ে দেখা দিয়েছিল ঘোর অনিশ্চয়তা। মালিকানার প্রশ্নে বিসিসিআই মামলা ঠুকে দিয়েছিল মুম্বাই আদালতে। দীর্ঘদিনের প্রেমিক ও ব্যবসায়িক অংশীদার নেস ওয়াদিয়ার সঙ্গে বিয়ের কাজটি সেরে ফেলার কথা থাকলেও এখন সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে দুজনের। প্রীতি জিনতার এতোটা উৎসাহের পরও গত আসরগুলোতে সাফল্যের দেখা পায়নি দলটি। তাই বন্ধুরা সবাই মিলে যেমন ক্লাব কিনতে চেয়েছিলেন, তেমনি সবাই আবার ক্লাব বিক্রির সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন। এক্ষেত্রেও প্রীতি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়ে হিরো হোন্ডার কাছে দল বিক্রি করতে দেননি। এতে জয় হয়েছে প্রীতিরই কারণ আদালতের তাদের পক্ষে রায় দিলে এবারের আইপিএলেও খেলার অনুমতি পায় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। প্রীতির এমন সাহসী সিদ্ধান্ত এবং ক্রিকেটপ্রেম তাকে ভক্তদের কাছে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
জুহি চাওলা : কলকাতা নাইট রাইডার্সের অঘোষিত রানী
বলিউড কিং শাহরুখ খান, জুহি চাওলা ও তার স্বামী জয় মেহতার রেড চিলিজি এন্টারটেইনমেন্ট ৭৫.১ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিকানা। শাহরুখের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তার সঙ্গে প্রিন্স অব ক্যালকাটা সৌরভ গাঙ্গুলি যোগ দেওয়ায় অনেকটাই ঢাকা পড়ে যান জুহি চাওলা। তবে কলকাতা নাইট রাইডার্স মানেই কিং খান শাহরুখ একা নন। শাহরুখের ক্যারিশমার কাছে যতই চাপা পড়ে যান না কেন, কলকাতা নাইট রাইডার্সের খুঁটিনাটি সবকিছু জুহির নখদর্পনে। মাঠে থেকে দলকে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি ভূমিকা রাখছেন খেলোয়াড় নির্বাচনেও।
আইপিএলের প্রথম আসর থেকেই শাহরুখ ব্যস্ততার কারণে দলের সব মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে জুহি একাই সামাল দেন সবকিছু। সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে জরুরি আলোচনা বা ইডেনের বর্তমান পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখা, সবকিছুতেই উপস্থিত থাকেন জুহি।
জুহি নিজে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা না হয়েও মনে-প্রাণে কামনা করেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের জয়। এ প্রসঙ্গে সদাহাস্যোজ্জল জুহি বলেন, আমি ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা। এটাকে বড় করে দেখি না। কারণ এইরাজ্যের মানুষদের কাছেও পেয়েছি অনেক অনেক ভালোবাসা। তাই কলকাতার মানুষদের জন্যই দলটার জয় চাইছি। এক্ষেত্রে জুহি কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী শাহরুখ ও লোলিত মোদির নাম। জুহির মতে, শাহরুখ ছিল বলেই হয়ত আমি আইপিএলের সঙ্গে জড়াতে পেরেছি। ওর সঙ্গে আমার সবসময়ই মধুর সম্পর্ক অক্ষুন্ন ছিল এবং থাকবে। অন্যদিকে লোলিত মোদি আমাদের দল কিনতে উৎসাহিত করেছিলেন, এবারের আসরে তাকে খুব মিস করব।
অবশ্য কলকাতার ঘরের ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলিও থাকছেন না এবারের আইপিএল আসরে । তাই কলকাতার অনেক সৌরভ ভক্তই নাইট রাইডার্সের উপর থেকে তাদের সমর্থন সরিয়ে নিতে পারে, এমন আশংকা ছিল। এই ভাবনা থেকেই জুহি নিজে গিয়ে কথা বলেছেন গাঙ্গুলির সাথে এবং কলকাতার সবগুলো ম্যাচ মাঠে এসে উপভোগ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিজের ক্রিকেটবুদ্ধি নিয়ে জুহি সবসময়ই নীরব থাকলেও এসব তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে তার জুড়ি নেই। তাই তো মাঠের কিং খানকে ছাপিয়ে অনেকাংশে কলকাতা নাইট রাইডার্সের রানী হয়ে উঠেছেন জুহি চাওলা।
শিল্পা শেঠি: রাজস্থান রয়্যালসের নয়া বাজিগর
আইপিএলের প্রথম আসরে রাজস্থান রয়্যালস মালিকানা কিনেছিলেন দুই ব্যবসায়ী মনোজ বাদালে এবং লাসিয়ান মারডক। পরে ২০০৯ সালের ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিনদশেক আগে শিল্পার তখনকার বয়ফ্রেন্ড রাজ কুন্দ্র (বর্তমান স্বামী) প্রেমিকার জন্য মাত্র ১৫.৪ মিলিয়ন ডলারের (ভারতীয় মুদ্রায় ৭৫ কোটি টাকা!) বিনিময়ে প্রথমবারের আইপিএল চ্যাম্পিয়ন ‘রাজস্থান রয়্যালস’-এর ১১.৭% শেয়ার কিনে উপহার দেন।
দলের আংশিক মালিকানা পেয়েই শিল্পা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তার দায়িত্বের কথা, ভুলেও ভাববেন না যে আমার সাংঘাতিক দূরদর্শিতার কারণেই আমি দলটির মালিকানা পেয়েছি। এটা মূলত সম্ভব হয়েছে রাজের ভালবাসার কারণেই। তবে আমার যোগদানে দলের গ্ল্যামার কোশেন্টে নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং এক্ষেত্রে আমি কাজ করতে চাই।
যেমন কথা তেমনই কাজ। শিল্পা মালিকানা নিয়েই নেমে পড়েন রাজস্থান রয়্যালসের মিউজিক ভিডিও নির্মাণে এবং দলের জন্য সুন্দরী চিয়ারলিডার্সদের খুজে বের করতে। দলের থিমসঙ নিয়ে মিউজিক ভিডিও নির্মাণের সময় শুটিংস্পট রাজস্থানের জয়পুরে গিয়ে তত্বাবধান করেছেন। দলের চিয়ারলিডার্সদের খুঁজে বের করার জন্য একটি রিয়েলিটি শোর আয়োজনও করেছিলেন শিল্পা শেঠী।
বলিউডি ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছেন শিল্পা, তাই আইপিএলের মাধ্যমে ফোকাসে থাকতে চাচ্ছেন এমন সমালোচনা হারহামেশায়াই হলেও অকপটে তিনি জানিয়েছেন ক্রিকেটের প্রতি তার ভালবাসার কথা। আসলে ভালবাসাটা শিল্পার একার নয়। শিল্পার বাবা ক্রিকেট ভালবাসতেন, সেই সূত্রে ক্রিকেটের প্রতি গভীর প্রেম তার ছোটবেলা থেকেই ছিল। রাজস্থান রয়্যালস নিয়ে কোথাও কথা বলার সময় রাজের প্রতি কৃতজ্ঞতার জানাতে ভোলেন না তিনি। শিল্পার কথায়, আসলে রাজ পুরোপুরি ক্রিকেটপাগল। তার উপর ও থাকে লন্ডনে, যেখানে এই খেলাটার জন্ম। এই দুয়ে মিলে রাজের আইপিএলে ঢুকে পড়া এবং রাজের ইচ্ছেতেই আমার।
এত টিমের ভীড়ে রাজস্থান রয়্যালসকে কিনতে আগ্রহী হলেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে শিল্পা বলেন, একদম আন্ডারডগ টিম হিসেবে আইপিএলের প্রথম আসরে খেলেছিল রাজস্থান। কেউই ভাবেনি এই দলটি ভালকিছু করতে পারবে, অথচ প্রতিযোগিতা শেষে জয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল দলটি। আসলে রাজস্থান রয়্যালস দলটির লড়াই আমাকে আমার বলিউডের শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, তাই আমার কথাতেই রাজ দলটি কিনতে আগ্রহী হয়।
বলিউডের হটগার্ল শিল্পা শেঠির অংশগ্রহণ হয়ত রাজস্থান রয়্যালসকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারেনি কিন্তু সারা বিশ্বে রাজস্থান রয়্যালসের জনপ্রিয়তা অনেকখানি বেড়ে গেছে এবং ব্যাবসায়িকভাবেও লাভবান হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময় ১৬২০, এপ্রিল ৩০, ২০১১