বাবা কমল দাশগুপ্ত ছিলেন প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত সাধক ও সুরকার। মা ফিরোজা বেগম উপমহাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী।
শুরুতেই শাফিন আহমেদ জানিয়ে দিলেন, নজরুল সঙ্গীত দিয়েই তাদের দুই ভাইয়ের গানে হাতেখড়ি হয়েছিল। তিনি বলেন, শৈশবে মায়ের কাছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রজাপতি প্রজাপতি’ গানটি প্রথম শিখেছিলাম। তখন বোধহয় আমার বয়স ছিল ৯ বছর। আমার গাওয়া সেই গানটি ওই সময়ই রেকর্ড আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। শৈশব-কৈশোরের দীর্ঘসময় আমি নজরুলসঙ্গীত নিয়েই ছিলাম। ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে গান করতে দেখে গানের নেশায় পেয়ে বসে আমাকেও। স্কুলের বা এলাকার যে কোনো অনুষ্ঠানে কমল দাশগুপ্ত আর ফিরোজা বেগমের ছেলে বলে জোর করে হলেও আমাকে গান গাওয়ানো হতো।
বাবা সুরসাধক কমল দাশগুপ্তের কথা জানতে চাইলে শাফিন আহমেদ বললেন, যখন বুঝে ওঠার বয়সে পা রাখি তখনই বাবাকে হারাই। তবু চোখ বুঝলেই বাবাকে মনে পড়ে। সারাক্ষণ তিনি সুরের মধ্যে নিমগ্ন থাকতেন। আমার বাবা নজরুলের প্রায় ৪০০ গানের সুর করে গেছেন। বাবার সান্নিধ্য খুব একটা না পেলেও কেউ তার কথা স্মরণ করলে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠে। সংসার-সন্তানের চেয়েও তার কাছে সুর-সাধনায় ছিল বড়। এজন্য আমার মা বা আমাদের কারো কোনো ক্ষোভ নেই। এরকম এক সুরসাধক পিতার সন্তান হয়ে পৃথিবীতে আসায় আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।
শাফিন আহমেদ জানালেন, বাবা কমল দাশগুপ্ত সুর আর সঙ্গীত পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাদের প্রতি বাড়তি নজর দিতে পারেন নি । তবে মা ফিরোজা বেগম বাবার অভাব বুঝতে দেননি । নজরুল সঙ্গীত নিয়ে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মা সবসময়ই তাদের বুকে আগলে রেখেছেন। নজরুল সঙ্গীত চর্চা, গানের জগতে ক্যারিয়ার আর পরিবার সবই সমানভাবে এগিয়ে নিয়েছেন মা ফিরোজা বেগম। নজরুল সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি একজন আদর্শ গৃহিণীর মতোই সন্তানদের লালন-পালন আর রান্নাবান্নার কাজ করেছেন তিনি।
গান শেখার ভিত্তিটা নজরুল সঙ্গীত হলেও পরবর্তীতে ওয়েস্টার্ন মিউজিকে ঝুঁকলেন কী করে ? উত্তরে শাফিন আহমেদ বললেন, পড়াশোনা করতে যাওয়ার সূত্রে আমাদের তারুণ্যের দিনগুলো কেটেছে লন্ডনে। সে সময়ই আমি আর হামিন ওয়েস্টার্ন মিউজিকের সংস্পর্শে আসি। ক্যান্ট্রি মিউজিক, জ্যাজ, রকএনরোল আমাদের আকর্ষণ করে। চর্চার মধ্য দিয়েই ওয়েস্টার্ন মিউজিকে আমরা হাত পাকাই। কলেজ-জীবন থেকে শুরু করি স্টেজ পারফের্মন্স। দেশে ফিরে সেই বিদ্যা প্রয়োগ করি মাইলসে।
গত কয়েক বছর ধরে শাফিন আহমেদকে বিচ্ছিন্নভাবে নজরুল সঙ্গীত গাইতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নজরুল সঙ্গীতের আগেও মধ্যে ছিলাম আর এখনও আছি। ব্যান্ডের গান করি বলে জোর দিয়েছি ওয়েস্টার্ণ মিউজিকের প্রতি। কিন্তু নজরুল সঙ্গীত থেকে দূরে থাকা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। মা প্রতিদিন নজরুল সঙ্গীত নিয়ে বসতেন। মন জুড়ে থাকতো মায়ের মুখ থেকে শোনা গান। মায়ের গাওয়া গানগুলোই ঘরে গুনগুন করে গাইতাম। নজরুলসঙ্গীতের সঙ্গে সখ্যতা আমাদের আজীবনের। ছোটবেলায় যখন নজরুল সঙ্গীত গেয়েছি আর বড় হয়ে যেহেতু ঘরে মায়ের গানগুলো গাই, তাই ভাবলাম শ্রোতাদের সামনেও গাওয়া যেতে পারে। এই ভাবনা থেকেই আমি কিছু নজরুল সঙ্গীত গাইছি। ভবিষ্যতে নজরুল সঙ্গীতের একটি অ্যালবাম প্রকাশেরও ইচ্ছে আছে।
শাফিন আহমেদের গাওয়া নজরুল সঙ্গীতে কিছু ওয়েস্টার্ন মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার চোখে পড়ে। বিষয়টি সম্পর্কে শাফিন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, যুগটা এখন বিশ্বায়নের। এক মহাদেশের সুরের সঙ্গে অন্য মহাদেশের সুর এসে মিলেমিশে যাচ্ছে। তবে নজরুল সঙ্গীতের সুর বিকৃতির পক্ষে আমি নই। অবশ্যই সুর ঠিক রেখে গানটিকে উপলব্ধি করে আবেগ দিয়েই গাইতে হবে। সুরের সঙ্গে যদি মানানসই হয় তাহলে নজরুল সঙ্গীতে ওয়েস্টার্ন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা যেতেই পারে। এতে যদি গানটি আরো শ্রুতিমধুর হয় তাহলে তা অবশ্যই আমি স্বাগত জানাবো।
সবশেষে শাফিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হলো তার পছন্দের কয়েকটি নজরুলসঙ্গীত সম্পর্কে। তিনি জানালেন, মায়ের গাওয়া সব নজরুলসঙ্গীতই তার প্রিয়। তবু মায়ের কন্ঠে একটু বেশি ভালো লাগে ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাবো’, ‘মোর ঘুমও ঘোরে এলে’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়’, ‘নিশিথে ঘুম ভেঙে যায়’, ‘আমি চাঁদ নই অভিশাপ’, ‘কতো জল ও কাজল চোখে’ প্রভৃতি। মা ফিরোজা বেগমের রেকর্ডকৃত বেশিরভাগ গানই শাফিন আহমেদের সংগ্রহে আছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময় ২০২০, মে ২৪, ২০১১