বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত মূকাভিনয় গুরু পার্থপ্রতিম মজুমদার সম্প্রতি অর্জন করেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘শভেলিয়ে দ্য লোরদ্রে দে আর্ত এ দে লেতার্স’ বা ফরাসিদেশের নাইটহুড। বাংলানিউজের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রবাব রসাঁ টেলিফোনে কথা বলেন পার্থপ্রতিমের সঙ্গে।
‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেতর সেতু’ হিসেবে সম্মানিত পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেন, ফরাসি সরকার শিল্প-সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাকে যে পুরস্কার দিয়েছে তা তার নিজের দেশ বাংলাদেশকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে।
পার্থ তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘এটি আমার মাতৃভূমির প্রতি অসামান্য সম্মান। ’ তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি এমন বিরল সম্মানে ভূষিত হলেন।
পার্থ প্রায় তিরিশ বছর ধরে প্যারিসে বসবাস করছেন। মূকাভিনয়ের এই মহান গুরু জানান, ফরাসি সরকার সারা পৃথিবীতে অবদান রাখার জন্য শিল্পী-লেখকদের এই পুরস্কার প্রদান করে। ‘তারা অনেক বছর থেকে আমার কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। তারা আমার কাজের প্রশংসা করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে আমার কাজ ফরাসি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ’
শুধু ফরাসি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধই নয়, বরং পার্থ শিল্প-সাধনাকে সারা দুনিয়ায় প্রচারও করে চলেছেন। তাই ফরাসি সরকারের কাছে তিনি একজন ‘বীর’। এই বীরের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার ১০ মে এই পুরস্কারের ঘোষণা দেয়।
গেল ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে পার্থ প্যারিস ফিরে যান। ভাবতেও পারেননি এমন বিরল সম্মান অপেক্ষা করছে তার জন্য। ‘ঢাকায় প্রায় ছ মাস ছিলাম। অনেক দিন থেকে ফ্রান্সে কোনও নাট্যদলের সঙ্গে কাজের কোনো চুক্তি করছি না। একটাই আশা, বাংলাদেশে মূকাভিনয়ের জন্য একটি একাডেমি করব। ’
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এবারের সফরে এই কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই মনটা একটু খারাপ ছিল। ’
কিন্তু পার্থর মন বেশিদিন খারাপ থাকেনি। দিন দশেক পরই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ‘১০ মের ফরাসি সরকারের ঘোষণাটি আমার মনের সাময়িক কষ্টগুলো মুহূর্তেই দূর করে দিল,’ হাসিমুখে কথাটি বললেন তিনি।
পার্থ ছিলেন কালজয়ী ফরাসি মূকাভিনয় শিল্পী মার্সেল মারসিউর ছাত্র। শুধু ছাত্রই নন, তিনি পেয়েছিলেন তার ‘সন্তানের’ অধিকার। নিজের কাজ দিয়েই পার্থকে প্রমাণ করতে হয়েছিল তিনি মারসিউয়ের যোগ্য শিষ্য। পার্থ তাই পরবর্তীকালে খেতাব পান ‘মাস্টার অব মাইম’।
তাই এই মাহেন্দ্রক্ষণে পার্থ স্মরণ করলেন তার প্রিয় গুরুর স্মৃতি। বললেন, ‘আমি সম্মান জানাই মারসিউকে। তিনি আমাকে তার ছেলের সম্মান দিয়েছিলেন। আমার এই পুরস্কার আমার গুরুকেও সম্মানিত করেছে। ’
মূকাভিনয়কে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও একই সঙ্গে সবচেয়ে আধুনিক শিল্প হিসেবে উল্লেখ করে পার্থ বলেন, ‘পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন তার জনপ্রিয় বডি মুভমেন্টগুলো শিখেছিলেন মারসিউয়ের কাছে। আমি চাই এই জ্ঞান বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের ভেতর ছড়িয়ে দিতে। ’
পার্থর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি, পাবনা জেলায়। বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস, মা সুশ্রিকা বিশ্বাস। বাবা ছিলেন একজন প্রেস ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ধ্রুপদীসঙ্গীতের খ্যাতমান শিল্পী পণ্ডিত বারীণ মজুমদার পার্থকে দত্তক নেন। তিনি পার্থদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।
ছেলে বারীণ মজুমদারের কাছে থাকবেন, এতে পার্থর মা-বাবা হয়তো খুশিই হয়েছিলেন। তাই ঢাকায় এসে প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস ওরফে ভীম হলেন গেলেন পার্থপ্রতিম মজুমদার।
পার্থ ঢাকায় এসে মূকাভিনয়ের চর্চা শুরু করেন ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি। এ বিষয়ে আরো পড়াশোনার জন্য তিনি বৃত্তি পান ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে। সেই বৃত্তি নিয়ে তিনি প্যারিসে যান ১৯৮১ সালে। তারপর থেকে সেখানেই স্থায়ী বসবাস।
এই মূকাভিনয় গুরুর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের মূকাভিনয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা। ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে আমাকে মাইম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বারবার আমি একই কথা বলেছি যে, এই একাডেমি আমি আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশেই করতে চাই,’ পার্থ বাংলানিউজের কাছে তার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করলেন।
২০০৯ সালে ফ্রান্সে পার্থ পেয়েছিলন সম্মানজনক ‘মলিয়ের অ্যাওয়ার্ড’। বাংলাদেশে ২০১০ সালে তাকে সম্মানিত করা হয় ‘একুশে পদক’ দিয়ে। বাংলানিউজকে তার গভীর বিশ্বাসের কথা জানিয়ে পার্থ বলেন যে, দেশে যে মাইম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তার মধ্য দিয়ে এ দেশের ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন সমৃদ্ধ হবে। এই মুহূর্তে এটাই আমার সবচে বড় কাজ।
বাংলাদেশ সময় ১৮০০ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১১