পপগুরু আজম খান নেই, তার মৃত্যুতে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শুধু সঙ্গীত নয়, শোবিজের সব শাখার শিল্পীরাই আজম খানকে হারিয়ে শোকাহত।
আজম খান শুধু দিয়েই গেছেন : চাষী নজরুল ইসলাম
আজম খানের তুলনা আজম খান নিজেই। আজকের প্রজন্মের শিল্পীরা যেসব গান গাইছে তা প্রবর্তন করে গেছেন আজম খান। আজম খান একজন সঙ্গীতশিল্পী বা বীর মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি একজন বড় মনের মানুষ । শিশুসুলভ সরল মনের অধিকারী ছিলেন বলেই শিশুরা ছিল তার বন্ধু। তার সঙ্গে আমার কমলাপুর বাজারে প্রায়ই দেখা হতো। কথা হতো। তবে দুঃখ একটাই আমরা জাতি হিসেবে খুবই কৃপণ, জীবিত অবস্থায় আজম খানকে সরকারিভাবে সম্মাননা জানানো হয়নি। হয়তো মৃত্যুর পর তাকে কোন পদক দেয়া হবে। দুর্ভাগ্য এটাই পদকটা তিনি নিজ হাতে নিতে পারলেন না। তবে এসব বিষয়ে তার কোন আক্ষেপ ছিল না। আজম খান নিজে কখনোই কিছু চাননি, শুধু দিয়েই গেছেন।
আজম খান আসলে একটা ইতিহাস : নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু
আজম খান ছিলেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ঘাটতি ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তার গানের মধ্য দিয়ে। আজম খান আসলে একটা ইতিহাস। ইতিহাসের অনিবার্যতায় তার জন্ম। মানুষের সংকটময় মুহূর্তে আজম খানের সৃষ্টি। তিনি গানের মধ্য দিয়ে ভালবাসার কথা বলেছেন। হতাশা থেকে বের হতে তিনি যে ধারার প্রবর্তন করেছিলেন তা সেই সময়ের মানুষের কাছে মনে হয়েছিল পরিবর্তনের সুবাতাস। সঙ্গীতে এই নতুনধারার প্রবর্তকের অবদান ভুলে যাবার মতো নয়।
গুরু হওয়া এতো সহজ নয় : মামুনুর রশীদ
দেশের জন্য আজম খান নির্ভিক যোদ্ধা হিসেবে নিজের জীবনকে বাজি ধরেছিলেন, অন্যদিকে সংস্কৃতির উন্নয়নে তার চেষ্টা তাকে মহান করেছে। গুরু হওয়া এতো সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশে গানের জগতে যে নতুন ধারা তিনি প্রবর্তন করেছিলেন সেই কল্যাণে তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের মহান ব্যক্তি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি তার আচার-ব্যবহার দিয়ে দেশের অনেক মানুষের একজন প্রাণের মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। দেশে তার অনেক ভক্ত, তার গানের ভক্ত অগণিত। এমন একজন শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধার চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক।
বাংলাদেশের মানুষ তাকে অনাদিকাল মনে রাখবে : আসাদুজ্জামান নূর
পপসম্রাট আজম খানের মৃত্যুতে হাজার হাজার মানুষের মতোই আমি ব্যথিত। বাংলাদেশের পপসংগীতকে দিকনির্দেশনা দেয়ার অগ্রপুরুষ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে পপসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা অনেক বড় কাজ। একাত্তরে তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধেও পর নতুনধারার গান প্রবর্তন করে তিনি আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ তাকে অনাদিকাল মনে রাখবে ।
আজম খান ভুল করে ভুল দেশে জন্ম নিয়েছিলেন : সৈয়দ আবদুল হাদী
এই যুগে দুনিয়াতে আজম খানের মতো সরল-সহজ মানুষ হয় না। আমার দুনিয়াতে আমি এরকম একজনকেও পাইনি। নির্লোভ-নিরপরাধ মানুষগুলো হয়তো এভাবেই অকালে ঝরে যায়। ঝরে গিয়ে বলে যায় তাদের না বলা দুঃখের গল্প। আজম খানের মতো মানুষ এই দেশে জন্মেছেন, এই দেশের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, এই দেশের বাংলা গানকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিয়েছেন; কিন্তু দেশের কাছ থেকে তিনি কোনো স্বীকৃতি পান নি। তাই মনে হয়, আজম খান ভুল করে ভুল দেশে জন্ম নিয়েছিলেন।
তাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি : সুবীর নন্দী
আজম খানের মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হলো। আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তিনি, সঙ্গে যোগ করেছেন সংগীতের নবধারা। বেদনার কথা হলো, আজম ভাইয়ের গড়া সোনালী সময়টা আমরা ধরে রাখতে পারি নি। তাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। যতদূর জানি উনি তার শেষ অ্যালবামটি নিয়ে বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন। এসব কথা মনে হলে নিজেদেরকে অপরাধী মনে হয়। আমাদের শিল্পী সমাজ তাকে অসম্ভব ভালবাসতো- শ্রদ্ধা করতো। আমি নিজেও তাকে গুরু বলে ডাকতাম।
স্মৃতি হানা দিচ্ছে মনের গহীনে : হানিফ সংকেত
যতদিন ব্যান্ডের গান বেঁচে থাকবে এই দেশে ততদিনই বেঁচে থাকবেন আজম খান। আজম খানের সঙ্গে অনেক অনেক স্মৃতি হানা দিচ্ছে আমার মনের গহীনে। শুধু স্বান্তনা এটুকুই যে, আজম খানের জীবনের শেষ গানটি করার সুযোগ আমার হয়েছিল। গানটি হচ্ছে- ‘আমি বাংলাদেশের আজম খান, বাংলাদেশে গাই পপ গান, জারি সারি ভাটিয়ালি এক মায়ের সন্তান’। গানটি তৈরির সময় আজম খানের যে উচ্ছ্বাস আর আগ্রহ ছিল সেটা বলে বোঝানোর মতো নয়। কে জানতো যে, এটাই তার জীবনের শেষ পারফর্মেন্স শেষ রেকর্ডিং।
আজম খানের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি : আইয়ুব বাচ্চু
আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, কারণ আজম খানের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি। শেষ করতে পারিনি উনার সঙ্গে আমার ‘গুরু তোমায় সালাম’ অ্যালবামটি। দুজনেরই অনেক স্বপ্নের উদ্যোগ ছিল এই কাজটি। আজম ভাইয়ের অসুস্থতার কারণে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি। গুরুর মৃত্যুর কারণে এটি আর কোনোদিনই করা সম্ভব হবে না। মায়ের মৃত্যুর বহুবছর পর আবারও মনে হলো, আমি জীবন থেকে বড় একটা বটবৃক্ষ হারিয়েছি।
আজম খান একজন অমৃতের সন্তান : জেমস
গুরু আজম খানের মৃত্যর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। একটি সূর্য অস্ত গেল। এখন থেকে আমরা একটা সূর্যহীন সময় পার করবো। এই অন্ধকারে তার রেখে যাওয়া গান আমাদের আলো যোগাবে। সেই আলো বুকে ধারণ করে আমরা হাঁটবো অনন্তকাল, পাড়ি দেবো জোছনা রাত। সকাল হবে না জানি, সূর্য্য উঠবে না জানি, আজম ভাই ফিরবে না জানি- তবুও তার কণ্ঠ আর গান নিয়ে আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। আজম খান আসলে একজন অমৃতের সন্তান।
মানুষের ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে : ফাহমিদা নবী
আমার পিতৃতুল্য মানুষ ছিলেন আজম খান। যখনই কোথাও দেখা হতো গভীর মমতা নিয়ে আমার মাথায় তিনি হাত রাখতেন। আমার জন্য শুভ কামনা করতেন। তিনি শুধু নতুনধারার গানের প্রবর্তকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এই মানুষটি কোনো রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি পান নি। এটা দুঃখজনক। তবে সরকারী স্বীকৃতি না পেলেও তিনি পেয়েছেন অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। মানুষের ভালোবাসা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।
বাংলাদেশ সময় ১৯১৫, জুন ০৭, ২০১১