‘বিন্দু’ নামটির অর্থ ক্ষুদ্রতম। জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও মডেল আফসানা আরা বিন্দু নামের মতো নিজেকে সীমিত রাখেন নি।
ছোটবেলা থেকেই বিন্দু ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। মাথা ভর্তি ছিল যতো উদ্ভট স্বপ্ন। বাদামের টুকরি গলায় ঝুলিয়ে ‘এই বাদাম চিনা বাদাম’ বলে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হতো শহরের অলিগলি। কখনো ইচ্ছা হতো বাসের কন্ট্রাকটর হয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে কিংবা ট্রাকের ড্রাইভার হতে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলানো শুরু হলো স্বপ্নের। এ বিষয়ে বিন্দু বলেন, ‘আমার ছোটবেলার স্বপ্নগুলো ছিল বড় অদ্ভুত। বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র হওয়ার কথা কখনো ভাবি নি, শোবিজে কাজ করার কথা তো কল্পনাও করিনি কখনো। ভাবতাম, বড় হয়ে আমি বাদামওয়ালা বা বাসের কন্ডাক্টর হবো। নয়তো হবো ট্রাকের ড্রাইভার। বাবা-মা এসব শুনে কেবল হাসতেন। কোনোদিন বকা দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। আমি সবসময় তাদের প্রশ্রয় পেয়ে এসেছি। ’
বাবা আফসার আলী ও মা রওশন আরার ইচ্ছে ছিল মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এক মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বিন্দু-ই প্রথম। কিন্তু বিন্দু কি আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়রের ধার ধারে। ছোট ভাই আপন ঝগড়া-ঝাঁটি আর দুরন্তপনা করেই কাটিয়ে দিতো বেলা। বিন্দুর ছোটবেলার ডানপিটে স্বভাবের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে তার কপালের কাটা দাগে। তার মুখের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে কপালের বড় একটা কাটাদাগ। কপালে কিসের দাগ ? অন্তত কোটিবার এই প্রশ্নটি শুনেছেন। টেপ রেকর্ডারের মতোই বিন্দুর মুখস্ত উত্তর, ‘ছোটবেলায় অনেক দুষ্টুমি করতাম তো, এটা তারই চিহ্ন। ’ এটা তো মাত্র একটা চিহ্ন। বিন্দু জানালেন, শৈশবে-কৈশোরে দুরন্তপনার শাস্তি হিসেবে কপালে ১১টি, ঠোঁটে ৫টি, দুই হাতে প্রায় ১৫টি সেলাই নিতে হয়েছে তাকে। তার দুই হাঁটুই মচকানো। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একবার তো চারতলা গড়িয়ে নিচেই পড়ে গিয়েছিলেন! জীবন নিয়ে টানাটানির মতো অবস্থা।
শোবিজের প্রতি বিন্দুর একসময় তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহকে তার অদ্ভুত ভালো লাগতো। তার ছবি-নাটক দেখতে দেখতেই শোবিজের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। তবে এই আকর্ষণটা তৈরির পেছনে বাবা-মায়ের অবদানও কম নয়। এ প্রসঙ্গে বিন্দু বললেন, আমার বাবা একসময় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে কাজ করতেন। তিনিই প্রথম লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারে আমাকে অংশ নিতে বলেন। আমি খুব একটা সিরিয়াস ছিলাম। আমার চেয়ে বরং মা ছিলেন বেশি সিরিয়াস। এন্ট্রির একদম শেষ সময়ে মা আমাকে রেজিস্ট্রেশন করান। আমি আসলে বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। মিডিয়ায় আমি আজকের বিন্দু হয়ে উঠতে পেরেছি বাবা-মায়ের উৎসাহ-উদ্দীপনায়।
বিন্দু মনে করেন,লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৬ অংশগ্রহণ-ই পাল্টে দেয় তার জীবনের গতিপথ। প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আপ হওয়ার পর তার অভিষেক হয় মিডিয়ায়। হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী অবলম্বনে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘দারুচিনির দ্বীপ’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন বিন্দু। ধনী বাবার আহ্লাদী মেয়ের চরিত্রে নিজের সুপ্ত অভিনয়-প্রতিভাকে মেলে ধরেন। বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হওয়ার পর মডেলিংয়েও তৈরি করেন ক্রেজ। এরপর একে একে লাক্স, একটেল, ফিনলে চাসহ অনেকগুলো বিজ্ঞাপন চিত্রের মডেল হন তিনি।
‘দারুচিনির দ্বীপ’ ছবিতে পর থেকেই একের পর এক কাজের অফার বিন্দুর পিছু নেয়। কিন্তু তার পক্ষে তখন এতোটা সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্রী বিন্দু পড়ালেখা শেষ করার জন্য সময় নেন। চলতে থাকেন ধীরে ধীরে। অনেক বড় বড় নির্মাতাকেও এ সময় সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, পড়ালেখা শেষ করে অবশ্যই কাজ করবেন।
কথা রেখেছেন বিন্দু। পরীক্ষার পরপরই পুরো দমে তিনি কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে একঘন্টার নাটককেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এখন অবশ্য ধারাবাহিক নাটকেও অভিনয় করছেন। এ বিষয়ে বিন্দু বলেন, ‘আমি মূলত আমার পড়াশোনাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই শুরুতে ধারাবাহিক নাটকে সময় দিইনি। এখন পড়ার চাপ নেই বলে একঘণ্টার নাটকের পাশাপাশি ধারাবাহিক নাটকেও কাজ করছি। তবে এ কথা সত্যি, ধারাবাহিক নাটকের চেয়ে একঘণ্টার নাটকে কাজ করে আমি বেশি আরাম পাই।
বিন্দু অভিনীত সেরা একক নাটকের মধ্যে রয়েছে মেজবা শিকদারের ‘বিলম্বিত টিকিট’, সালমান হায়দারের ‘তারকা’, সকাল আহমেদের ‘ফান উইথ ম্যাডাম ইঙ্গা’ ও ‘দুটি ঘাস ফড়িং ও একটি মৃত্যু’, সোহেব আলমের ‘ফাও’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিকের মধ্যে রয়েছে এজাজ মুন্নার ‘নীড়’, অরুণ চৌধুরীর ‘লীলাবতী’, কায়সার আহমেদের ‘জহুর আলী জহুরী’, সকাল আহমেদের ‘ক্লোজ চ্যাপ্টার’, হৃদি হকের ‘ইকারুসের ডানা’, রায়হান খানের ‘থার্টি ফার্স্ট মে’, মোহন খানের ‘একলা পাখি’ প্রভৃতি।
ঈদের বাকি এখনো কয়েক মাস। আর এখনই ঈদের নাটক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আফসান আরা বিন্দু। প্রতিদিনই থাকছে শুটিং। এরই ঈদের ডজন খানেক নাটকে অভিনয় করে ফেলেছেন। গত রোজা ও কোরবানী ঈদের মতোই এবারও সম্ভবত বিন্দু হতে যাচ্ছেন সর্বাধিক নাটকের অভিনেত্রী।
‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবির পর বিন্দু অভিনীত ২টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবি দুটো হলো খিজির হায়াৎ পরিচালিত ‘জাগো’ ও পিএ কাজল পরিচালিত ‘পিরিতির আগুন জ্বলে দ্বিগুণ’। অভিনয় করছেন সোহেল আরমান পরিচালিত ‘এই তো প্রেম’ ছবিতে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ ছবিতে মাধবী চরিত্রে অভিনয় করছেন বিন্দু। এতে তার সহশিল্পী শাকিব খান। তবে ইদানিং চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে তার তৈরি হয়েছে অনীহা। এ প্রসঙ্গে বিন্দু বললেন, ‘আমাকে দিয়ে চলচ্চিত্র অভিনয় হবে না। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, চলচ্চিত্র থেকে বিতাড়িত হয়েই ঘরের মেয়ে আবার ঘরে ফিরে এসেছি। এই তো প্রেম ছবিটি হয়তো আমার বড়পর্দার শেষ কাজ। তবে ভালো চরিত্র আর গল্প পেলে দু`একটি ছবিতে অভিনয়ের কথা ভাবতেও পারি। `
বিন্দুর সমসাময়িক প্রায় সবাই এরই মধ্যে বিয়ের বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছেন। বিন্দু দেরি করছেন কেন? জবাবে বিন্দু বললেন, ‘আমি এখনই বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি না। গত তিন মাসে পাঁচ নায়িকার বিয়ে হয়েছে। আমি অন্তত এ যাত্রায় বিয়েশাদি করছি না, এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমার ইচ্ছে প্রেম করে বিয়ে করার। কিন্তু এখনও আমার কপালে প্রেমই জুটে নি। প্রথমে প্রেম করব। এরপর জানাজানি হবে। লেখালেখি হবে। তারপরই তো বিয়ে! এ অনেক সময়ের ব্যাপার। কাজ নিয়ে দম ফেলার ফুরসতই পাই না। প্রেম বা বিয়ে নিয়ে ভাবার সময় নেই। ’
বাংলাদেশ সময় ১৮৩০, জুন ০৯, ২০১১