ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

বিক্ষত দর্শক ও সিনেমা দেখার গল্প

সোহেল রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১১

ঢাকা: বুকে আর পিঠে ক্ষতের দাগ মোস্তফার। সলিমুল্লাহ এক পা নিয়ে এসেছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

আনন্দের মাঝে ওরা চেষ্টা করছে চাপা কান্নাটা আরো আড়াল করতে। মিলনায়তন ভর্তি সব দর্শকই তরুণ। টাইটেল ও আবহ সঙ্গীতের সাথে সাথে সবাই যেন খুঁজে পায় জীবনে বেচেঁ থাকার নতুন সুর। প্রশান্ত আনন্দে নেচে ওঠে মন। রানওয়ে দিয়ে বিকট শব্দে আকাশের বুক চিরে উঠছে বিমান। সে শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। নড়েচড়ে বসে দর্শক। তাদের চোখ আর মন কেড়ে নিয়ে বড় পর্দায় এগুতে থাকে ছবিটি।

বোমায় ঝাঁঝাঁলো ক্ষতের বিষাদে কাতঁর মোস্তফা। বড় বোনের সঙ্গে সেদিনও এমনি করেই সিনেমা দেখতে গিয়েছিল সে। ঈদের আনন্দের সঙ্গে সুষ্ঠু নির্মল বিনোদন উপভোগ করবে- বোনের এমন সুপ্ত বাসনা ফেলতে পারেনি মোস্তফা। সিনমো দেখতে হলে যায় ভাই বোন। কিন্তু কি হল? চোখ ভিজে যায় মোস্তফার। মুখ ফুটে আর বলতে পারে না ছিন্নভিন্ন হয়ে বোমায় উড়ে যাওয়া প্রিয় বোনটির কথা। মোস্তফা ও সলিমুল্লাহ অনেক বছর পর এসেছে সিনেমা দেখতে।  

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিলনায়তনে একটি চেয়ারও ফাকাঁ নেই। ঠাসাঠাসি করে বসা দুই হাজারেরও অধিক দর্শক ডুবে গেছে সিনেমার ভেতর। তাদের চোখ দেখে মনে হলো তারা যেন গিলে খাচ্ছে ছবিটি। শটের পরিবর্তন হয়, সিকোয়েন্স বদলায়,  গল্পও ভাঙতে থাকে ক্রমান্বয়ে। ভাঙে না শুধু দর্শকের মনোযোগ।   ছবির গতির সাথে সাথে তাদের মনোযোগও যেন বাড়তি মাত্রা পায়।

ভাগ্যহত তরুণটির সামনে কোন আদর্শ নেই। দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটছিল এবড়ো-থেবড়ো পথে। সমাজের নিঠুর বাস্তবতায় তিক্ত-বিরক্ত সে। ধর্মের মুখোশ পড়া জঙ্গিবাদের বিষাক্ত ছোবলে হতাহত তরুণটি একসময় ফিরে আসে। সে দেখে,  বেঁচে থাকার জন্য এখনো মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ, প্রকৃতির মধৃর আবহ, বোনের মিঠে খুনসুটি আরো কত কিছু রয়ে গেছে। এমন এক দারুণ গল্প রানওয়ে ছবিটির।  

‘তারেক মাসুদের ছবি সবসময় অন্যরকম। সমাজ-বাস্তবতার  ছবি। কোথাও কোন খুঁত থাকে না। ‘মাটির ময়না’, ‘অর্ন্তযাত্রা’ ছবি দুটি দেখেছিলাম আগে। আজ দেখলাম ‘রানওয়ে’। অসাধারণ একটি ছবি। বন্ধুদের নিয়ে ছবিটি খুব উপভোগ করলাম। ’ ছবি শেষে মিলনায়তনের বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ইশিতা। নাওমী, ইমরানও সায় দিল ওর সাথে। ওরা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

‘আমি চেষ্টা করেছি ছবিটি পড়ার। এর আগে ছবিটি আরো একবার দেখেছিলাম সিলেটে। আজ আবার দেখলাম। একটি ছবি মানুষকে এমন কঠিনভাবে নাড়া দিতে পারে, দায়িত্ব ও মনুষত্ববোধের উদয় ঘটায়- রানওয়ে দেখে আমি বুঝেছি। ’ যোগ করলেন কলেজ শিক্ষক শামীম মাজেদ।

রানওয়ের প্রদর্শনী রূপ নেয়  বড় একটি উৎসবের। সে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে। ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মত।

যেন সিনেমা ফেরি করেই ফিরছেন দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ। সারা দেশে ছুটে চলেছেন ছবি নিয়ে। চলচ্চিত্র বিমুখ দর্শকরা আবার ফিরছেন। অনেকদিন পর ছবি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাড়ি যাচ্ছেন তারা।

দেশের শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র সবকিছুই যেন বন্দী হয়ে আছে ঢাকায়। জেলা শহরে বসে সুযোগ নেই ভালো একটা ছবি দেখার। অথচ ঢাকার মত অন্যান্য জায়গায়ও রয়েছে রুচিশীল বোদ্ধা দর্শক। এ অবস্থায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন একটি ভালো ছবি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেনি কেউই।

বিগত ৬ মাসে রানওয়ে ছবির প্রদর্শনী হয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের প্রায় ৫০টি জেলা শহরে।

মধ্যবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর দর্শক দেখেছেন ছবিটি। তবে অন্যান্যদের পাশে প্রতিটি শো’তে ছিল তারুণদের উপচে পড়া ভীড়। পুরুষের পাশাপাশি নারী দর্শকদের ছিল সমান অংশ গ্রহন।

এ বিষয়ে তারেক মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার একটা টার্গেট ছিল ভাল ছবি দেখার সুবিধা বঞ্চিতরাসহ সব ধরনের দর্শকের কাছে ছবিটি  নিয়ে যাওয়া। তাদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণরা এগিয়ে থাকবে। আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ভবিষ্যতে স্কুল কলেজ পর্যায়ে ছবিটি দেখানো হবে। তারপর উন্মুক্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করব। বিটিভি বা এরকম কোন চ্যানেলে সবার জন্য ছবিটি প্রদর্শনের পরিকল্পনা আছে বলে তিনি জানান।    

এরমধ্যেই মেরিল-প্রথম আলো সেরা চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছে ‘রানওয়ে’। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই ছবিটি সাদরে গ্রহণ করেছেন। ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে সব শ্রেণীর দর্শকদের কাছ থেকেও। কয়েকটি আর্ন্তজাতিক পরিবেশক ইতোমধ্যে ছবিটি বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনের বিষয়ে আগ্রহও প্রকাশ করেছেন।   তবুও দেশের বাইরে বা আর্ন্তজাতিক কোনো ফেস্টিভ্যালে এখনো ছবিটি পাঠাননি তারেক মাসুদ।

কেন জানতে চাওয়া হলে বাংলানিউজকে তারেক বলেন, দেশের বাইরে পুরষ্কৃত হলে সেটা  এদেশে তিরষ্কৃত হয়। মাটির ময়না’র তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি এখনো বাইরে পাঠাইনি রানওয়ে। যেখানে মাটির ময়না দেখাতে পারিনি সেখানেও রানওয়ে দেখিয়েছি। এ দেশের দর্শক ছবিটি গ্রহণ করেছেন। বিদেশে ছবিটির মূল্যায়ন না হলেও এখন আর আমার কোন দু:খ থাকবে না।

তারেক মাসুদসহ সাম্প্রতিক কালে দেশের সুস্থধারার নির্মাতাদের বেশ কিছু ছবি মুক্তির পর এখন বলা যায়, ভালো ছবির এক রকম জোয়ার বইছে। সরকার এতে কি রকম ভুমিকা পালন করতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে তারেক মাসুদ বলেন, সরকারকে কিছু করতে হবে না। তারা শুধু সুস্থধারার ছবির ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালেই যথেষ্ট।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনটি মুখর হয়ে ওঠে করতালিতে। প্রদর্শনী শেষে দর্শকদের চমকে দিয়ে তারেক মাসুদ মঞ্চে নিয়ে এলনে মোস্তফা ও সলিমুল্লাহ কে। সিনেমা হলে গিয়ে বোমা হামলায় মারাত্মক আহতদের দু’জন এরা। দর্শকরা প্রকাশ করলেন তাদের জন্য দু:খ ও ভালবাসা।

মিলনায়তন ছেড়ে একে একে সবাই ফিরতি পথ ধরলেন। রাতের অন্ধকারের ভরে নুয়ে পড়েছে প্রকৃতি। মোস্তফা আর সলিমুল্লাহ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। পাশে যেতেই বলে ওঠলো, রানওয়ে দেখে সেই বোমা হামলার কথা মনে পড়ছে খুব। চোখ টলমল করছে দুজনেরই। আমরা তো বেঁচে গেলাম তবু। কিন্তু যাদের হারিয়েছি-তারা কি আর ফিরে আসবে? সমাজের এই অসুস্থ দানবগুলোর কি বিচার হবে না ?

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ০৩ আগষ্ট, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।