পাবনা: ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে’-গানটির মতো প্রচণ্ড গরমে একটু স্নিগ্ধ শীতল পরশ পাবার বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার হলেও গ্রামীন কারিগরের তালের পাতা দিয়ে তৈরি তালপাখার বাতাস যেন তুলনাহীন।
অব্যাহত লোডশেডিং এ বৈদ্যুতিক ফ্যানের পাখা বন্ধ থাকলেও প্রাণ জুড়িয়ে দেয় তালপাখার বাতাস।
চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দুরে চাটমোহর উপজেলার মহেশপুর গ্রাম পরিচিত ‘তালপাখার গ্রাম’ হিসেবে। এই গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার গ্রীষ্ম মৌসুমে তালের পাখা বিক্রি করে বাড়তি আয় করে নেন। এই গ্রামের পাখা তৈরির কারিগররা গরমের সাথে পাল্লা দিয়েই যেন তারা তালের পাখা বানান।
তালপাখা বিক্রি গরম মৌসুম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। বছরের বাকী সময় তারা রিক্সা-ভ্যান চালায়। কেউ চুল কাটার কাজ করেন, কেউ শহরে যায় কাজের সন্ধানে। কেউবা দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে অন্যের বাড়িতে শ্রম দেন। মহেশপুর পাখা গ্রামে কবে থেকে পাখা তৈরির কাজ চলছে তার সঠিক কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেনি। তবে তারা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছে বলে জানান।
সম্প্রতি চাটমোহর-পাবনা সড়কের পূর্ব পার্শ্বে মরা চিকনাই নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট জনপদ মহেশপুর গ্রামের পাখা পল্লীতে গিয়ে দেখা গেল পাখা তৈরির এক মস্তবড় কারবার। সবাই ব্যস্ত পাখা তৈরিতে। নারী-পুরুষের সাথে আলাপ করে জানা যায় তাদের দুঃখ-দূর্দশা আর প্রবঞ্চনার কথা।
মহেশপুর গ্রামে দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে শতাধিক পাখা তৈরি ও বিক্রির কাজ করে। এই গ্রামের দুলাল হোসেনের স্ত্রী ময়না খাতুন (৪০) বাংলানিউজকে জানান, আমার বাপ-দাদারা পাখা তৈরির কাজ করে গেছে। আমি জন্মের পর থেকে আমার বাবার কাছ থেকে এই কাজ শিখে এখন পর্যন্ত করে আসছি।
দুলাল হোসেন (৪৫) বাংলানিউজকে জানান, আমি ২৫ বছর ধরে পাখা তৈরি করে বিক্রি করছি। আমাদের একশ’ পাখা তৈরি করতে খরচ হয় ২শ টাকা। পাইকারী বিক্রি করি ৩শ’ টাকা। আর প্রতিদিন দুই থেকে তিনশ’ পাখা তৈরি করা সম্ভব হয়।
দুলাল হোসেনের ছেলে মাসুদ রানা বাংলানিউজকে জানায়, আমি স্কুলে লেখাপড়ার ফাঁকে যতটুকু সময় পাই আমি বাবা-মাকে পাখা তৈরির কাজে সাহায্য করি। একই গ্রামের আফসার আলী (৫০) গরমের ৬ মাস পাখা তৈরি করে। নিজের তৈরি পাখা নিয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ফেরি করে পাখা বিক্রি করে। এই পাখা বিক্রির আয় দিয়ে তার সংসার চলে।
পাখা তৈরি করতে কারিগরদের নানা রকম সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। আকতার হোসেন (৩৫) বাংলানিউজকে জানান, বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তাল পাতা কিনে আনতে হয়। একটি তালগাছের পাতা (১৩টি ডাগুর) কিনতে খরচ হয় ১শ’ টাকা। পাতা গাছ থেকে কেটে আনতে কাটাওয়ালাকে দিতে হয় গাছ প্রতি ১০ টাকা। সেই তালপাতা ভ্যানে করে বাড়িতে আনতে ভাড়া দিতে হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। প্রতি ভ্যানে ১০/১৫ টি গাছের তালপাতা আনা যায়। আকতার হোসেন আরো জানান, তালপাতা বাড়িতে আনার পর রোদে শুকিয়ে আবার ছায়ায় ঠাণ্ডা করতে হয়। তারপর সাইজ করে তালপাতা কাটতে হয়। এরপর পাখা তৈরি করতে উপকরন প্রয়োজন হয় গুনা, সুতা, বাঁশ, রং। তালপাতা সাইজ করে কাটার পর বাঁশের তৈরি কাঁঠির মধ্যে তালপাতা পরিয়ে, গুনা দিয়ে আটকাতে হয়। তারপর সুতা দিয়ে সেলাই করতে হয়। সবশেষে রং দিয়ে ইচ্ছামত ফুল, পাখি, গাছপালা ছাপ দিয়ে তৈরি হয় তালপাতার পাখা।
স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, মুলত: মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর থেকে এখানে পাখা তৈরি শুরু হয়। গ্রামটির প্রায় সবাই অভাবী। মাত্র দশটি পরিবার স্বচ্ছল কৃষক। আসলে এই গ্রামের পাখা পল্লীটাকে আমাদের বাঁচাতে হবে। গ্রামীন ঐতিহ্য কুটির শিল্পকে রক্ষা করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। দাদন ব্যবসায়ীরা পাখা কারিগরদের জোঁকের মত শুষে খাচ্ছে। সমস্ত পরিশ্রম করছে কারিগররা আর সুফল ভোগ করছে দাদনদাররা। সরকার যদি পরিবার প্রতি ৩/৪ হাজার টাকার ঋনের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে চাটমোহরের এই পাখা পল্লীটাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তা না হলে তারা বছরের পর বছর নিঃস্ব থেকে নিঃস হতে থাকবে।
সরকারিভাবে সুনজর দেওয়া হলে মহেশপুর তালপাখার গ্রামে গড়ে তোলা যেতে পারে পাখা শিল্পের গ্রাম হিসেবে-এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।