দুটি বর্ণের একটি ছোট্ট শব্দ, বাবা। ‘বাবা’ কথাটার মাঝেই যেন লুকিয়ে রয়েছে শ্রদ্ধা, নির্ভরশীলতা, আশ্রয় ও ভালবাসা।
সম্ভবত সকল সন্তানের আদর্শিক পুরুষ বলা যেতে পারে পাশাপাশি আদর ও শাসনের প্রতিক। অভিভাবকত্বের আসনে বসে বাবা সন্তান ও সংসারের জন্য বিশেষ অবদান রাখেন। প্রত্যেক সফল মানুষের সফল হয়ে উঠতে যে মানুষটি অনেক পরিশ্রম, অনেক ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, ছায়া, দিক-নির্দেশনা দিয়ে বড় করে তোলেন, তিনি বাবা।
আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক বিকেল চারটা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর বিকেল হতে না হতেই চলে যান আমাদের ফার্মেসীতে, এরপর রাত দশটা কখনও কখনও রাত এগারোটাও বেজে যায় দোকান বন্ধ করে কর্মচারিকে সব বুঝিয়ে দিতে।
এরপর বাবা বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পরেন এভাবেই কেটে যায় প্রতিটি দিন। আমার মা, ছোট্টবোন, আমি আর বাবা এই নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবার। আমি ঢাকায় পড়াশোনা করার সুবাদে বাসায় খুব একটা যাওয়া হয়না আর গেলেও দুই-একদিনের বেশি থাকি না।
একদিন ঘটে গেল সেই ঘটনা যা আমরা কেউ ভাবিনি প্রতিটি দিনের ন্যায় আমার বাবা দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার কথা আমার মা না খেয়ে বসে আছেন বাবা আসলেই খাবেন। আমার ছোট্ট বোনটা বাবার অপেক্ষায় বসে আছে। বাবা বাসা আসলেই সে তার স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে সই করিয়ে নিবে।
কোন বিষয়ে সে ভাল নাম্বার পেয়েছে, কোনটাতে তাকে নাম্বার কম দেয়া হয়েছে, কোন বান্ধবী কেমন নাম্বার পেয়েছে ইত্যাদি হরেক রকম কথার ঝুলি নিয়ে বসে আছে আমার বোন। রাত বারটা বেজে গেল আমার মা বাবাকে ফোন দিলেন কিš‘ রিসিভ করলেন না বাবা। মা ভাবলেন চলেই এসেছেন বোধহয় তাই রিসিভ করলেন না। আমার বোনটা বাবার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পরলো। মায়ের দুশ্চিন্তা বারতে লাগল হঠাৎ আমার বাবার মোবাইল থেকে কল আসলো আমার মা রিসিভ করলেন কিš‘ বাবা না কথা বলছে অন্য এক মানুষ। তিনি বললেন ভাবী একটু হাসপাতালে আসেন মাষ্টার সাহেব অসু¯’ হয়ে পরেছেন। আমার মা কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে ছুটে গেলেন সঙ্গে গেল আমার বোন। মায়ের ফোন পেয়ে ছুটে আসলেন মামারা হাসপাতালে গিয়ে মা যা দেখলেন তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমার বাবার সম্পুর্ণ মুখ রক্তে মাখামাখি, কপালে দুটা সেলাই, চামরা ছিলে গেছে বাম হাতের আনেকটা। এরপর বাবাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। ঘুমের ঔষধের কারনে বাবা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলেন।
মাকে যিনি ফোন করেছিলেন তিনি বললেন, ভাবী আমি বাসায় ফিরছিলাম হঠাৎ দেখি রাস্তায় এক লোক পরে আছে পাশেই মোটরসাইকেলটা। কাছে গিয়ে দেখি যে লোকটি আর কেউ নন আমাদের মাষ্টার সাহেব। এরপর কয়েকজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাবা সকাল বেলা বললেন, বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ কি যে হলো বিছুই বলতে পারি না শুধু এইটুকু মনে আছে আমি পরে গিয়েছিলাম।
আমি বাবার এই দুর্ঘটনার সময় বাসায় ছিলাম না দুর্ঘটনার রাতে আমি বাড়ি থেকে ঢাকায় আসছিলাম অর্থাৎ গাড়িতে ছিলাম। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আমার বাবা প্রায় সেরে উঠেছেন তখন এই ঘটনা আমার মামার কাছে শুনেছিলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গেই মাকে ফোন করলাম , মা বললেন, তোর বাবা তোকে জানাতে নিষেধ করেছে তাই... আমি কয়েকদিন পরেই বাড়ি গেলাম। মায়েক কাছে বিস্তারিত ঘটনা শুনলাম। বাবা প্রায় সু¯’ তবে শরীরের অনেক
জায়গায় কাটাছেড়ার দাগ।
আমার খুব কষ্ট লাগলো আর মনে পরে গেল সেদিনের কথা। মনের মধ্যে ভেসে উঠলো শেষবার টেস্ট পরীক্ষার পর বাড়ি গিয়েছিলাম তো ঢাকা ফেরার দিন সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরির পর বাস মিস হয়ে যাওয়ার ভয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রেডি হয়ে বাইকটা নিয়ে বাজারে গিয়ে বাবাকে বাইকটা দেই। যদিও বাবা বলেছিল যে, ‘আজ শরীরটা ভাল লাগছে না তোমাকে না বাইকটা আনতে নিষেধ করেছিলাম। ’ ‘আমি কি যেতে পারবো রাতে শরীরটা দুর্বল লাগছে। তুমি রিকসায় আসলেই পারতে। ’ আমি কিছু না বলেই গাড়িতে উঠেছিলাম।
আমি কান্না জড়িত কন্ঠে বাবার বুকে মাথা রেখে বললাম আমার জন্যই তোমার এ অব¯’া। বাবা বললেন ধুর পাগল এটা ভাগ্যেই ছিল আর বয়স হয়েছে না? আমার বোনটার মায়াভরা মুখটার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম যদি বাবার কিছু একটা হয়ে যেত! আমার বাবা এখন সু¯’ আর আগের মতো বটবৃক্ষের মতো তার সুবিশাল বুকে আগলে রেখেছেন আমাদের সবাইকে। বাবা দিবসে চিৎকার করে বলতে চাই বাবা তোমাকে অনেক ভালবাসি।