রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের এবারের ঈদ কেনাকাটায় হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সদ্য প্রয়াত জনপ্রিয় এই লেখকের হিমু চরিত্রের প্রিয় পোশাক ‘হলুদ পাঞ্জাবি’ বিক্রির তালিকায় শীর্ষে।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হিমু সিরিজের বিভিন্ন উপন্যাসে হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত হিমুকে নিয়ে পাঠকের ওপর হিমু ও তার হলুদ পাঞ্জাবির বেশ প্রভাব আছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে হলুদ বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিই গড়ে উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদ সবক্ষেত্রেই তার প্রভাব রেখেছেন নানাভাবে। ঈদের কেনাকাটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
ব্যবসায়ীরা জানালেন, নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের ভক্তরা তার এবারের ঈদে প্রিয় লেখকের স্মৃতি সম্বলিত পোশাক কিনে প্রিয় লেখকের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছেন। ঈদের কেনাকাটা হলো, প্রিয় লেখকের একটি স্মৃতিও থাকলো। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট ও ফতুয়া এখন তরুণদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
তারা জানান, হুমায়ূন আহমেদের জীবিতকাল থেকেই হিমুর টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি কম-বেশি বিক্রি হলেও মৃত্যুর পর এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে। বরং মেয়েরাও হলুদ ফতুয়া কিনছে। সেইসঙ্গে বাচ্চাদের হলুদ ফতুয়ার বেশ চাহিদা দেখা যাচ্ছে।
দাঁড়কাক, কে-ক্র্যাফ্ট, সলো, বিহঙ্গ, খেয়া, ই-বাংলাসহ বেশ কয়েকটি দোকানে কদমফুল এবং হিমু টি-শার্ট পাওয়া যাচ্ছে। আর হলুদ পাঞ্জাবি, টি-শার্ট ও ফতুয়া প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে।
দাঁড়কাক ফ্যাশন হাউসের ব্যবস্থাপক নিশাত আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘টি-শার্ট ২২০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাঞ্জাবি ৮৫০ থেকে ১৮৫০ টাকায় বিক্রি করছি। তবে ৯৫০ টাকা দামের হিমু পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে। হিমু টি-শার্টের কয়েকটি রঙ আছে। এগুলোর বিক্রি অনেক ভালো। দিনে প্রায় ৪০টিরও বেশি বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে আরো আনা হবে। ’’
অন্যান্য দোকানে হিমু পাঞ্জাবি ৩৫০ থেকে ৮৫০ টাকা এবং টি-শার্ট ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত দাম রাখা হচ্ছে।
তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতৃর্থ বর্ষের ছাত্র খাইরুল ইসলাম মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘অামার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যার মারা গেছেন। কিন্ত তিনি আমাদের অন্তরে বেঁচে থাকবেন। তার লেখা বেশিরভাগ বইই পড়েছি। স্যারের হিমু সিরিজের বই পড়তে পড়তে নিজেকেই হিমু ভাবতে শিখেছি। এবারের ঈদ কেনাকাটায় হিমু স্টাইলে যা পাবো, তাই কেনার চেষ্টা করবো। মিসির আলীর মতো চশমাও কিনবো। ’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জাকারিয়া জানালেন, ‘‘হিমুর পোশাকের কথা শুনে কিনতে এসেছি। পুরো মার্কেট ঘুরে দেখে-শুনে কিনবো। ’’
সাধ, সাধ্য, শখ, স্বপ্ন সবই পূরণ হতে পারে আজিজের কেনাকাটায়। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানা উপাদান ব্যবহার করে পোশাকে শতভাগ বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তোলার কৃতিত্ব আজিজের ফ্যাশন হাউজগুলোর। কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মীদের আড্ডার জায়গা এ মার্কেটের প্রথম তিন তলায় প্রায় ২০০ বুটিক হাউসে দেশীয় কাপড়ে দেশীয় ঐতিহ্যনির্ভর পোশাক পাওয়া যায় বারো মাসই।
এবারের ঈদকে সামনে রেখে তাই জমে উঠেছে শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে কেনাকাটা।
এ মার্কেটের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানকার ক্রেতারা যেমন তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী, তেমনি বিক্রেতারাও সাধারণত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজসহ আশপাশের শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ এখানেই তাদের কেনাকাটা করেন।
এ মার্কেটের ঐতিহ্য বলতে সৃজনশীলতাকেই বোঝায়। সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এবারের ঈদেও দেশীয় কাপড় ও দেশজ ঐতিহ্য নির্ভর বিচিত্র পোশাক নিয়ে এসেছে আজিজের বুটিক শপগুলো।
আজিজের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ঢাকঢোল, নিত্য উপহার, তারা মার্কা, স্বপ্নবাজ, বাংলার মেলা, কে ক্রাফট, রঙ, সাদাকালো, বিবিয়ানা, লোকজ, মেঘ, প্রচ্ছদ, গোকুল, বরণ, নহলী, সুঁইসুতা, ঐশী, বৃত্ত, নন্দন কুটির, আতশী, ফাতিহা, টেক্কা, বাংলার রং, ১৯৭১, বাঙ্গাল, নক্ষত্র, মেঠোপথ, ক্যানভাস, বসন, সারাবেলা, চরকি, ষড়ঋতু, ব্যতিক্রম, ফেরিঅলা, বান্নি, যোগী, নক্ষত্র, আইডিয়াস, সেভেন, ইজি, কানন, দেশাল, গাঁওগেরাম, মেঠোপথ, ফোর ডাইমেনশন, পৌষ, প্রজাপতি, টোটেম, আবরু, চরকী, কিংবদন্তী, বেশভুষা প্রভৃতি।
ব্যবসায়ীরা জানান, হলুদ রঙ ছাড়া মেয়েদের টপস বেশ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই ভীড় বাড়ছে। তবে ৫ আগস্টের পর বিক্রি আরও বাড়বে। কারণ, তখন অনেকেই তাদের বেতন ও ঈদ বোনাস পাবেন।
দোকানিরা আরো জানান, আজিজ মার্কেটের ক্রেতারা মূলত তরুণ-তরুণী ও ছাত্র-ছাত্রী। দোকানিরা বেশ জোর দিয়েই বললেন, ক্রেতাদের এখানে আসতেই হয়। কারণ, এ মার্কেটে ক্রয়সাধ্যের মধ্যে ব্যতিক্রমী পণ্য পাওয়া যায়। বই ও ছেলেদের টি-শার্ট, পাঞ্জাবির সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্কেট বলতে আজিজ সুপার মার্কেট কার না চেনা?
বাঙাল ফ্যাশন হাউজের মালিক শামীম শাহরিয়ার বলেন, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে আসার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর এ পাঞ্জাবি হটকেকের মতো বিক্রি হতে থাকে। এখনো বিক্রি হচ্ছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি কর্মীদের প্রিয় আড্ডার এ জায়গাটিতে এখন হাজার হাজার সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা জড়ো হন প্রতিদিন। তবে আজিজ সুপার মার্কেটের মূল সুর তাতে পাল্টে যায়নি। বরং সৃষ্টিশীল চিন্তার নতুন নতুন প্রকাশ ঘটছে প্রতিনিয়ত।
আজিজের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশি খাদি ও তাঁতনির্ভর সুতি কাপড় দিয়ে সাজিয়েছে তাদের সম্ভার। তাই আজিজের শো-রুমগুলো থেকে ফুটপাত সর্বত্রই এখন ঈদের কেনাকাটার ব্যবস্তা।
দোকানিরা জানান, আজিজে পছন্দের রং, নকশা এবং সাইজের টি-শার্ট কেনা যাবে। আর এ টি-শার্টগুলোর দাম পড়বে ১৭০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। থ্রি পিস ৯০০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা পর্যন্ত।
বাচ্চাদের কাপড় ১৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। দেশি শাড়ি ১২০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। রুমাল ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা, মোবাইল ব্যাগ ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা এবং মাটির গহণা ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
তবে এই মার্কেটের সব ধরনের কাপড় ২ হাজার টাকার উপরে দামের কাপড় কম। শুধু বেনারসী, সিল্ক বা হাফসিল্কের কাপড়ের দাম একটু বেশি। ২৫০০ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম পড়ে। পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার সমন্বয়ে তৈরি ফতুঞ্জি ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। আজিজে ঈদ উপলক্ষে ৠাফেল ড্রয়ের মাধ্যমে ঈদ উৎসব ঘোষণাও করা হয়েছে।
আজিজের সালোয়ার-কামিজের ক্ষেত্রেও দেশি বুটিক শিল্পের সৃজনশীলতা উল্লেখ করার মতো। সালোয়ার-কামিজে বৈচিত্র্য আনতে ডিজাইনারদের চেষ্টার শেষ নেই। সালোয়ারের ক্ষেত্রে চুড়িদার, পাটিওয়ালা সালোয়ারের চাহিদা এবার বেশি। কামিজে এম্ব্রয়ডারি ও লেসের কাজ বেশি চোখে পড়ে। সালোয়ার-কামিজের ক্ষেত্রেও তরুণীরা সুতির পোশাককে প্রাধান্য দিচ্ছেন। সুতির ওপর এম্ব্রয়ডারির কাজ করা, চুমকি বসানো, স্প্রে, ব্লকসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে।
আজিজে বিদেশি পাঞ্জাবির চেয়ে অনেক উন্নতমানের পাঞ্জাবি তৈরি হচ্ছে। এখানে সিল্কের পাঞ্জাবির পাশাপাশি রয়েছে সুতি, খাদি, সিল্ক এবং তাঁতের কাপড়ের পাঞ্জাবি। হাতের কাজ, কারচুপি, স্প্রে, এম্ব্রয়ডারি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে এসব পাঞ্জাবিতে। এর মধ্যে সাদা সুতি পাঞ্জাবি ৪৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, রঙিন সুতি হাতের কাজের পাঞ্জাবি ৭৫০-৮৫০ টাকা, সিল্কের এক্সক্লুসিভ পাঞ্জাবি ১৮০০ টাকা থেকে বিভিন্ন দামের, শর্ট পাঞ্জাবি ৫৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা, প্লেন পাঞ্জাবি ৪৫০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা দাম ।
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আজিজ মার্কেটে আসেন কম দামে ব্যতিক্রমী পোশাকের টানে। পোশাকের ডিজাইনগুলোই তাদের বেশি আকর্ষণ করে। আজিজের দোকানগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে দেশীয় সুতি, তাঁত, খাদি, এন্ডি ও মুগা কাপড়ে তৈরি সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া ও রঙ-বেরঙের পাঞ্জাবি এবং নানা রকম শাড়ি। আধুনিক ও মনোরম ডিজাইনের শাড়ি, তৈরি সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, টি-শার্টসহ রকমারি পোশাক ।
পোশাক ছাড়াও প্রিয়জনকে দেওয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে আজিজে। বই যে কোনো সময়েরই শ্রেষ্ঠ উপহার। ঈদেও তাই প্রিয় মানুষের জন্য কিনতে পারেন রবীন্দ্র রচনাবলী, নজরুলের বই, শরৎচন্দ্র, ডক্টর লুৎফর রহমান, ডেল কার্নেগি বা হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় আরও অনেকের বই। তাছাড়া দিতে পারেন যে কোনো পছন্দের পত্রিকার ঈদসংখ্যা, রান্নাসংখ্যা ও ফ্যাশন ক্যাটালগ।
আজিজের কেনাকাটা ঈদ ছাড়াও সারা বছরই জমে থাকে। কারণ, আজিজ মার্কেট দেশি বুটিক হাউজগুলোর প্রাণকেন্দ্র।