গত ১৫ দিন ধরে কনকনে ঠাণ্ডায় উত্তরাঞ্চলের মানুষদের ভোগান্তি আর দুর্দশা আমরা টিভি, পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত দেখছি। অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ও এনজিওগুলো তাদের সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে—এটাই নিয়ম।
সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে অবিলম্বে বেশ কিছু মেডিকেল কলেজের ডাক্তার ও ছাত্রদের যথেষ্ট ওষুধসহ উত্তরাঞ্চলে পাঠিয়ে দিন। পর্যাপ্ত গরম কাপড়-কম্বল ইত্যাদি সরবরাহ করুন, প্রতিদিন গরম খাবারের বন্দোবস্ত করুন। উত্তরাঞ্চলে যেখানে তিন ডিগ্রি তাপমাত্রায় নেমে এসেছে সেসব অঞ্চলে ‘ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর “ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট” ব্যাটালিয়ন পাঠানো উচিৎ।
জনগণকে তথ্য দিন, কীভাবে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে, যদি তথ্যে ঘাটতি থাকে, জেনে নিন কীভাবে শীতপ্রধান দেশের মানুষ ২০০ বছর আগে এই কনকনে শীতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতো। তখন ঘরে ঘরে কোনো সেন্ট্রাল হিটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিল। সেসব উদাহরণ থেকে আমাদের নতুন উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হবে, কারণ পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে ভয় বা উদ্বেগের কারণ রয়েছে যথেষ্ট এবং জনগণ কীভাবে সেই উদ্বেগ বা সংকট মোকাবেলা করতে পারে তার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে হবে।
ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার ১০টি উপায় (টিপস)
১) যদি সম্ভব হয় তিনটি পোশাক পরিধান করুন। প্রথমে গেঞ্জি যেটা শরীরের ৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রার নিশ্চিত করবে। তারপর সূতি জামা যা গেঞ্জি ও শরীরের তাপমাত্রার রক্ষক হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষে পুল-অভার বা জ্যাকেট বাইরের হিমেল ঠাণ্ডা ঢুকতে প্রতিবন্ধক হিসেবে করবে। যদিও এভাবেই সবাই করেন, তবু তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হলো: একটি মোটা কাপড়ের চেয়ে তিনটি কাপড় শরীরের “থার্মিক ব্যালেন্স” রক্ষায় ভালো কাজ করে। আর নারীরা নিচে আঁটোসাটো পোশাক পরে শাড়ি পড়ুন। দুটো মোজা পায়ে দিন, তাতে প্রথমটা পায়ের উষ্ণতা বাইরে যেতে বাধা দেবে আর দ্বিতীয়টা বাইরের তাপমাত্রা পায়ে ঢুকতে প্রতিবন্ধকতার কাজ করবে।
২) আপনার চুল্লিটি, যদি সম্ভব হয়, বসার ঘরে বা শোয়ার ঘরে নিয়ে আসুন তাতে আপনার ঘরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বাড়বে, খাবারের কাটাকাটি ধোওয়া-মোছার কাজ রান্না ঘরে করুন। চুল্লিতে শুধু রান্নার কাজটি বসার ঘরে বা শোয়ার ঘরে করুন।
৩) যদি লাকড়ির চুল্লিতে রান্না করেন আর চুল্লি সরানো সম্ভব না হয় তবে রান্নার পরে ছাই ও জলন্ত কয়লা একটি মাটির পাত্রে অথবা কড়াইয়ে ভরে নিয়ে আপনার চৌকি বা খাটের নিচে রাখুন, এতে ঘরের তাপমাত্রা বাড়বে। পাথর উষ্ণতাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে পারে, তাই রান্নার সময় কিছু ইট-পাথর চুল্লিতে ঢুকিয়ে রান্না করুন এবং তারপর সেগুলো ঘর গরম রাখার জন্যে ব্যবহার করুন।
৪) দরজা জানালার ফাঁকগুলো মাটি ও খড়কুটোর কাদা মিশ্রণের প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করুন, বাইরের হিমেল হাওয়া ঘরে ঢোকার সব দুর্বল জায়গা বন্ধ করুন ছেঁড়া কাপড় দিয়ে।
৫) বাতাসের ধর্ম হলো, গরম বাতাস ওপরে যায় আর ঠাণ্ডা বাতাস নিচে নামে। তাই আপনার চৌকি অথবা খাটের পায়ের নিচে দুটি করে ইট দিয়ে খাটটিকে ২০ সেন্টিমিটার উচু করুন। যাদের চৌকি অথবা খাট নেই তারা সরাসরি মাটিতে না শুয়ে, খড় বিছিয়ে বা খবরের কাগজ বিছিয়ে তারপর কাঁথা বা তোষক বিছাবেন।
৬) বেশি লোকজন এক ঘরে থাকলে বাতাসের সঞ্চালন বেশি হবে ও ঘর গরম থাকবে।
৭) আপনার তোষক অথবা ম্যাট্রেসের নিচে খড় (সিম্পল ধানের খড় ৫ সেনটিমিটার পুরু) বিছিয়ে দেবেন, এতে আপনার বিছানা অনেক গরম থাকবে অথবা চাদরের নিচে খবরের কাগজ বিছিয়ে দেবেন। ফোম (Styrofoam) একটি ভালো অন্তরক (isolator)। কারণ ফোমের মধ্যে প্লাস্টিকের ফেনায় আটকে রাখা গ্যাস বুদবুদ রয়েছে, যেটা তাপমাত্রা প্রতিরোধ করে।
৮) খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন সুপ (ডাল জাতীয় তরল খাবার) থাকতে হবে, ডাল, সবজি এবং সম্ভব হলে গরুর মাংসের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে সুপ তৈরি করুন, সুপ অনেকক্ষণ শরীর গরম রাখে।
৯) সূর্য আমাদের বিশ্বজগৎকে সবচেয়ে বেশি এনার্জি দেয়। সূর্যকে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি নিজের অজান্তেই, কাপড় শুকানো, ধান শুকানো, ফলমূল শুকানো ছাড়াও আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্যে। যদিও শীতের মৌসুমে সূর্যের দেখা মেলে কম। তবু যখন সূর্যের দেখা মিললেই ঘরের ভেতরে আলো প্রবেশ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) সৌরশক্তির বৈজ্ঞানিক ব্যবহার আজকাল আমাদের দেশেও বাড়ছে। সাধারণ মানুষ সূর্যকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে না পারলেও নিজের মতো করেই ব্যবহার করতে পারে। যেমন কাঁচের বন্ধ জানালা দিয়ে আলো ঢুকে ঘর গরম রাখতে পারে, সৌর শোষক (solar absorver) রাবারের কালো পাইপ দিয়েও পানিকে ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গরম করা যায়, শীতের দিনেও এটা সম্ভব (যদি রোদ থাকে) সেই ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গরম করা জল ঘরের ভেতরে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে (থার্মো-ডাইনামিক: কারেন্ট সাইকেল)।
ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কম্বল গায়ে হাত গুটিয়ে শুধু আগুন পোহালে হয়ত ঘণ্টা খানেক শরীর গরম হবে, কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় দিন হয় তাই আমাদের যথেষ্ট ছোটাছুটি ও কাজকর্ম করে নিজের শরীর গরম রাখতে হবে। নতুন উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হবে। কিচেনে রান্না করার গরম তাপমাত্রা শোয়ার ঘরে বা বসার ঘরে ঢোকানো যায় তার বৈজ্ঞানিক সমাধান দিতে হবে, এতে কোনো বড় পুঁজির দরকার হয় না টিনের পাইপ তৈরি করে কিচেনের গরম বাতাস বসার ঘরে বা শোয়ার ঘরে সঞ্চালন করা অতি সাধারণ একটা পদ্ধতি। সৌরশক্তির দৈনন্দিন ব্যবহার সম্পর্কে এর পরবর্তী নিবন্ধে বিস্তারিত লেখার আশা রেখে আজ এখানেই শেষ।
লেখক: জার্মান প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ও সাংবাদিক, যোগাযোগ: [email protected]
সম্পাদনা: রানা রায়হান(আউটপুট এডিটর)