এই পৃথিবীকে সুন্দর করেছে প্রকৃতি ও মানুষ। সেই মানুষের আবার কত ধরণ সাদা-কালো, লম্বা-খাটো আরও ভাগে আছে নারী-পুরুষ।
হিজড়ারা তাদের জীবনের গল্প কীভাবে সাজাতে চায়? সে গল্প শোনার সময় কি আমাদের হয়? সবার হয়তো সময় বা আগ্রহ নেই এদের নিয়ে ভাববার। তবে কিছু মানুষ আছেন যারা এই হিজড়াদের পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
হিজড়া ও যৌন সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার, প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে কার্যকর ও সহায়ক সামাজিক এবং আইনি পরিবেশ তৈরির জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে কাজ করছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম হিরু জানালেন হিজড়াদের নিয়ে কাজ করার সেই শুরুর গল্প।
ছোটবেলা থেকেই মানুষের কষ্টগুলো যেন সব নিজের মনে হতো তার। ছাত্রজীবনে যতটুকু পেরেছেন চেষ্টা করেছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে থাকতে। তাইতো দীর্ঘদিন বস্তির ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়িয়েছেন। একসময় তিনি নাচ শিখতে ভারতে যান। জনপ্রিয় নিত্য শিল্পী হিরু ভারতে নাচের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন ১৯৯৫ সালের শুরুতে। তখন থেকেই নানা দেশে নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যান তিনি। বিদেশে হিজড়াদের জীবন-যাপন দেখে মুগ্ধ হন তিনি । তাদের সঙ্গে অন্য স্বাভাবিক নারী পুরুষের কোনো পার্থক্য নেই। কেউ তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় না। তারা শিক্ষিত, নিজেরা প্রতিষ্ঠিত, পরিবারের জন্য বোঝা নয় বরং সম্পদ।
তিনি যখন দেখলেন হিজড়ারা এতো ভালো জীবন যাপন করছেন, তখন বারবার এদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর কষ্ট-বেদনা, তাদের প্রতি অবহেলা দেখে তিনি ঠিক করলেন এদের জন্য কিছু করতে হবে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন, আমাদের সমাজে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলছে দেখলেও যেখানে ভালোভাবে নেয় না, সেখানে তাদের নিয়ে কাজ করাটা সত্যি তখন বড় চ্যালেঞ্জ।
হিরুর ভাবনার কথা জানতেন সালেহ আহমেদ (বন্ধুর প্রধান নির্বাহী)। তিনি বন্ধু হিরুর সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেন, তার ওপর আস্থা রাখলেন। দুই বন্ধুর হাত ধরে গড়ে উঠলো বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। আজ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত এনজিও। এখানে হিজড়ারা পায় মানবাধিকার, চিকিৎসা সেবা, আইনি সহায়তা, কাজের প্রশিক্ষণসহ সুস্থ যৌন শিক্ষা।
আনিসুল ইসলাম হিরু হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়ে বলেন, প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে সন্তানদের বিষয়ে। তিনি বলেন প্রতিটি হিজড়া যদি তার পরিবারে বেড়ে ওঠে তাহলেই সমাজে তারা মানুষের মর্যাদা ও সম্মান পাবে। বেশিরভাগ হিজড়া কিশোর বয়সে পরিবার থেকে বের হয়ে আসে, অথচ এই সময়টাই শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বর্পূর্ণ। তিনি বলেন, হিজড়াদের নিয়ে নানা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে আমাদের। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আরও সময় নিতে হবে। হিজড়াদের জন্য নেয়া সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়নের আহবান জানান তিনি।
কথা হয় ববি হিজড়ার সাথে, তিনি বলেন কুমিল্লায় তার জন্ম। ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও ছোট বেলা থেকেই নিজেকে নারী রূপে দেখতেই ভালোবাসতেন তিনি। আর এজন্য পরিবার থেকে নির্যাতন করা হতো। ববির এই মেয়েলীপনার জন্য তার মাকেও সবাই দোষারোপ করতো। এক সময় এই নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতেই ঘর ছাড়েন ববি। পরিবার থেকে বেরিয়ে এলেও দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। বাবার মৃত্যুর পর ছোট ভাই বোনদের পড়া-শোনার খরচ তিনিই দিয়েছেন। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। তবে কারও বিয়েতেই বাড়িতে যাননি। মায়ের মৃত্যুর পর এখন আর ভাই বোনদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। তবে তার তো ২৫ হিজড়া ভাইবোন নিয়ে সংসার। তাদের নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে বলে জানালেন ববি।
হিজড়াদের জীবনকে উন্নত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন উন্নত জীবন সম্পর্কে জানা বলে মনে করেন ববি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যে জীবন হিজড়ারা কখনো দেখেনি, বোঝেনি, তা পাওয়ার আগ্রহ থাকবে কেমন করে? আগে হিজড়াদের সমাজের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ দিতে হবে। একটি বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সুন্দর কিছু দেখলেই না বোঝা যায় আমার বাড়িতে এটা নাই।
ববি কষ্ট নিয়ে বলেন, হিজড়াদের তো ঘরই নেই, শিক্ষা নেই, একটা মন আছে শুধু। আমরা তো সব মানুষকেই ভালোবাসি আর সেই মানুষরাই আমাদের থেকে দূরে থাকে।
তবে আগের চেয়ে হিজড়াদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে এটাও লক্ষ্য করেছেন ববি। আর এজন্য গণমাধ্যমকে ধন্যবাদও জানান তিনি। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আগে তো নিজেকে মানুষই মনে হতো না, বন্ধু আমাদের বুঝিয়েছে, এখন অনেক হিজড়ার ব্যাংক একাউন্টও আছে অনেকে সমিতি করছে, পড়াশোনা করে অনেক কিছু শিখছে। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে আর এসব সচেতনতা তৈরি করেছে বন্ধু।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, লিঙ্গ বৈষম্যের ভিত্তিতে কাউকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। যৌন সংখ্যালঘুরা নিজেদের অবস্থার জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। তাই আর দশজন নাগরিকের মতোই তাদেরও মানবাধিকার রয়েছে। আর অধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে প্রথমে এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।