ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

এলডিডিপির সহায়তায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে নারীরা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২২
এলডিডিপির সহায়তায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে নারীরা

ঢাকা: ঝিনাইদহের বাদপুকুরিয়া গ্রামের আম্বিয়া খাতুন লাকীর ২০০৮ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বামী ও বাপের বাড়ি কোথাও একটু আশ্রয় পাননি। এরপর রাগে-ক্ষোভে কারও ওপর নির্ভরশীল না থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০১২ সালে পাড়ি জমান লেবাননে।

কিন্তু পরিবারের জন্য মন হু হু করে কাঁদে। বাবা মারা যাওয়ার পর লেবানন থেকে মায়ের জন্য টাকা পাঠাতেন তিনি। মা যাতে ভালো-মন্দ কিছু খেতে পারেন। পাশের বাড়িতে মা দুধ কিনতে গেলে অপমান করায় মাকে গরু কিনে দিতে চায়। কিন্তু মা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকায় গরু লালন-পালনে রাজি না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন তিনি।  

দেশে ফিরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) অফিসে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শে ২০১৮ সালে চারটি গাভী দিয়ে মা-বাবার দোয়া নামে একটি খামার শুরু করেন৷ সেই খামারে এখন ৪৫টি গাভী ও ১৬টি বাছুর রয়েছে। পাশাপাশি দেশি মুরগি, কবুতর, ছাগল ও ভেড়ার খামারও করেছেন। কারও কাছে জায়গা না পাওয়া আম্বিয়া এখন কয়েকটি পরিবারের আশ্রয় ও নির্ভরতার স্থান। খামারের আয় থেকে করেছে বাড়ি, দুইটি বিশাল মার্কেট। যা থেকে বছরে আয় হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা।  

জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানা রকম ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছোট-বড় খামারি থেকে শুরু করে প্রোডিউসার গ্রুপ, ব্যবসায়ী, ভোক্তা, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং এলডিডিপির ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মেকার, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সর্বোপরি দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  

গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকল্পের মোট সুফলভোগীর অর্ধেক (৫৫ শতাংশ) নারী সদস্য রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে নারী উদ্যোক্তা, দুগ্ধ উৎপাদক দল/কৃষক মাঠ স্কুল দল, গরু হৃষ্টপুষ্টকারী, সোনালি মুরগি পালনকারী, ছাগল/ভেড়া পালনকারী এবং দেশি মুরগি পালনকারী। এছাড়াও প্রকল্পের সব কার্যক্রমে অনগ্রসর যুবসমাজ, অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ বা প্রতিবন্ধীদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

প্রকল্পের কার্যক্রমে জেন্ডারের সমতা বিধানে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা হলো- নারীদের সম্পদে মালিকানা, ক্রয়-বিক্রয়, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, মার্কেটে প্রবেশাধিকার, সেবা, প্রযুক্তি, আর্থিক সুবিধাদিতে যুতসই প্রবেশাধিকার; কমিউনিটিতে অন্তর্ভূক্তি এবং অন্যান্য প্রোডিউসার গ্রুপে অংশগ্রহণ ও সব কাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন; আইনগত (বৈধ) ও আর্থিক সহায়তা/প্রণোদনা এবং কারিগরি সহায়তা সমভাবে প্রাপ্তির সুযোগ ইত্যাদি। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে প্রকল্পের সব কম্পোনেন্টে নারীর অংশগ্রহণ, ভূমিকা ও সামাজিক কাজে অন্তর্ভূক্তি চিহ্নিত করে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রাণিসম্পদ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারীদের সক্রিয় অন্তর্ভূক্তি রয়েছে ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের সব কাজে জড়িত নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় যে দুর্বলতা বা সুযোগের অভাব রয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে। এর ফলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পাবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের সমান অংশগ্রহণের ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।  

খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের বাদপুকুরিয়া গ্রামের আম্বিয়া খাতুন এখন খুলনার গৌরব।  

আম্বিয়া খাতুন লাকী বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৫ সালে বিয়ে হয় তার। সুখেই ছিল তাদের জীবন ২০০৮ সালে হঠাৎ তার স্বামী মারা যায়। এরপর আর স্বামীর বাড়িতে জায়গা হয়নি। চলে আসেন বাবার বাড়ি সেখানেও কয়েক বছর থাকার পর বাবার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আম্বিয়া। এরপর দালাল ধরে ২০১২ সালে লেবাননে চলে যায়। সেখানেও ভালোই ছিলেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল প্রবল। সেই ইচ্ছা থেকেই দেশে ফিরে খামার দেন তিনি।  

খামার দেওয়ার ইচ্ছা কেন হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মা পাশের বাড়িতে দুধ কিনতে গেলে তাকে দুধ না দিয়ে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখনই সিদ্ধান্ত নিই আমি দেশে গিয়ে খামার দিয়ে তাদের দেখিয়ে দেবো। সেই জেদ থেকে খামার করা। ৪টি গাভী দিয়ে ‘মা বাবার দোয়া’ নামে খামার শুরু করেছি বর্তমানে গরু আছে ৪৫টি। বাছুর আছে ১৬টি। প্রতিদিন দুধ পাই ৪ মণ। সঙ্গে ঘি ও মাখন তৈরি করি। এলডিডিপি প্রকল্প থেকে দুধ দোহানোর মেশিন ও মাখন সেপারেটের মেশিন দিয়েছে। প্রতিদিন ৮ কেজি মাখন হয়। সেটা জ্বালিয়ে ৪ কেজি ঘি তৈরি করি। ১৪০০ টাকা কেজি দরে ঘি বিক্রি করি। মাখন তোলার পর দুধ ৫০ টাকা কেজি দরে মিষ্টির দোকানে দিয়ে দেই। এছাড়া গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানির চাহিদা মেটাই। বর্তমানে আমি আমার দুই ভাইয়ের সংসার ও মাকে দেখা শোনা করি। পাশাপাশি ৪ জন কর্মচারী রয়েছে এরমধ্যে দুই জন নারী। ভাইয়েরাও আমাকে সাহায্য করে।  

তিনি বলেন, খুলনার বাসস্ট্যান্ডে দুইটি মার্কেট করেছি। একটি সাততলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দুইতলা পর্যন্ত করেছি। আর তার পাশেই টিনশেড দিয়ে একটি মার্কেট রয়েছে। বাড়িও করেছি দুইটা। মোট দোকান আছে ২শ’টি। ভাড়া পাই ৮০ হাজার টাকা।  

এতো কিছু কিভাবে করলেন জানতে চাইলে বলেন, এলডিডিপির সহায়তায় আমাকে ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। বর্তমানে আমি ব্যাংক এশিয়া থেকে এক কোটি টাকার হাউজ লোন নিয়েছি। এছাড়া ২০১৯ সালে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকার এবং পরে ৩০ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছি ৪ শতাংশ সুদে। সবমিলিয়ে প্রতিমাসে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিতে হয় ব্যাংককে৷ এটাকা আমাকে খামার ও দোকান ভাড়া থেকে দিতে হয়। খামার থেকে বছরে ষাঁড় গরু বিক্রি করি। ঋণের টাকা কিস্তিতে দেওয়া পর সব মিলিয়ে আয় হয় বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত আমি কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছি। গত বছর আইকন পুরুষ্কারে পঞ্চম স্থান পেয়েছি। পশুমেলা পুরস্কার পেয়েছি। ঝিনাইদহ নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতার প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। এখন আমার স্বপ্ন আমার খামারটাকে আরও বড় ও আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন খামারে পরিণত করা৷ আর আমাকে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার এবং এতো দূর আসা ও এই অর্জনের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এলডিডিপি প্রকল্পকে ধন্যবাদ জানাই।

এলডিডিপির উপকারভোগী ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার দিঘীরপাড় এলাকার খালপাড়া গ্রামে নাজমা বাংলানিউজকে বলেন, দেশি জাতের ২টা গাভী দিয়ে স্বল্প পরিসরে একটা খামার শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে সবার শ্রমে-ঘামে আস্তে আস্তে খামারটি বড় হতে থাকে। গরুর সংখ্যা বেড়ে দুই থেকে চার, চার থেকে ছয় হয়। কেনা হয় আরো একটি শংকর জাতের উন্নত মানের গাভী। স্বচ্ছলতা আসেনি তখনো ঠিকই, তবে সংসারের অভাব একটু একটু করে বিদায় নিতে শুরু করেছে। কিন্তু হঠাৎ আসা করোনা মহামারি শুধু নাজমার স্বামী জীবনই কেড়ে নেয়নি, তার প্রিয় খামারটিকেও তছনছ করে দিয়ে যায়। একদিকে নিজেদের খাবারের অভাব দেখা দেয়, অন্যদিকে গরুগুলোর খাবারেও সংকট সৃষ্টি হয়। সেসঙ্গে দুধ বিক্রিতেও নেমে আসে স্থবিরতা।

স্বামী মারা যাবার পরের সে অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, করোনার জন্য আমি দুধ বেচপার পারি নাই, মাইনষেরে দিয়া দিছি, ফালাইছি। গরুগুলার জন্যি খাবার কিনবার পারি নাই, খুব অভাবে চলছি। খাওয়া দিবার না পাইরা একটা গাভী বেইচ্চা দিছি। ভাবছিলাম আরো বেইচ্চা ফালামু। ঠিক এমন সময় নাজমা বেগমের বাড়িতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) থেকে একজন কর্মকর্তা গিয়ে হাজির হন। পরিবার ও খামারের খোঁজখবর নেন। খামারটি সচল রাখার জন্য সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। কর্মকর্তাটি নাজমার নাম ঠিকানার পাশাপাশি বিকাশ অ্যাকাউন্ট আরও নিয়ে যান। এর সপ্তাহ দেড়েক পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে নাজমার বিকাশ নাম্বরে ১৫ হাজার টাকা পৌঁছে যায়। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি তিনি। বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে নগদ টাকা হাতে পাওয়ার পর বেশ খানিকটা স্বস্তি নেমে আসে নাজমার পরিবারে।

নাজমা বলেন, প্রণোদনার টাকা পাওয়ার পর নাজমাকে আর গরু বিক্রি করতে হয়নি। উল্টো খামারের গরুগুলোর জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যাবস্থা করতে পেরেছেন, বর্ষা মৌসুমে গরুর ঘর মেরামত করতে পেরেছেন এবং কিছুদিন পর নতুন একটা বকনা গরুও কিনেছেন। এরফলে নাজমার মনোবল ফিরে এসেছে৷ দক্ষ হাতে সংসার ও খামারের হালধরে রেখেছেন তিনি। গরুর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, দুধ উৎপাদন বেড়েছে। এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন উন্নত জাতেন গুরু কেনার, খামারটি আরও বড় করার।  

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক ড. মো. গোলাম রব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এলডিডিপি অনেক কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মূল কাজ হলো (প্রোডিউচার গ্রুপ) পিজি গঠন। এখানে আমরা নারীদের সম্পৃক্ত করেছি। মোট এক লাখ ৮০ হাজার ৩৬৩ জন খামারির মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি হলো নারী খামারি। যাতে তারা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভেতরে সম্পৃক্ত হতে পারে। গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মুরগী, কবুতর, হাঁস, ভেড়া ও ছাগল খামারিদের মধ্যে শতভাগ হলো নারী খামারি। আর গরু ও মহিষ মোটাতাজা করণ ও ডেইরি খামারের বেশির ভাগই নারীদের৷ ফলে পিজি গঠনে নারীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। একটি পিজির ৩০ জন সদস্যের মধ্যে দুইজন নারীকে নির্বাহী কমিটিতে নেয়া হয়েছে। যাতে করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তিনি বলেন, নারী ক্ষমতায়নের একটি বড় দিক হলো তাদেরকে অর্থনেতিকভাবে সাবলম্বী করা। আমরা নারীদের ডেইরি খামারে মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী করে যাচ্ছি। পাশাপাশি নারীরা আয় করলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না।  আমরা সেখানে তাদেরকে বিভিন্ন কমিটিতে নিয়ে সিদ্ধানাত নেয়ার সক্ষমতা তৈরি করছি। এভাবে আমরা তাদেরকে অর্থনীতি ও নারী ক্ষমতায়নে সম্পৃক্ত করছি। এছাড়াও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ কামাজিক ও পারিবারিকখাতে যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সে কাজ করা হচ্ছে।

এছাড়া প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের সব কর্মকান্ডে জেন্ডারভিত্তিক অসমতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ‘স্যোশাল ও জেন্ডার উন্নয়ন’ বিষয়টি বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যা সব কম্পোনেন্টের অধীনে জেন্ডার সচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে জড়িত নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনবে। সেই সঙ্গে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রেও মূখ্য ভূমিকা রাখবে।

এলডিডিপি প্রকল্পে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন সেখানেও নারীতের সম্পৃক্ত করা হয়েছে জানিয়ে ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, নারীরা যাতে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বীর সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা রেখেছি। উপজেলা পর্যায়ে লাইভস্টক ফিল্ড এসিস্ট্যান্ড রয়েছে ৯৩০ জন  এখানেও নারী রয়েছে, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ৪৬৫ জন এরমধ্যে ১৫৫ নারী রয়েছে যা প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সিভিল এয়ার্কাসের জন্য ৩ জন সহকারী প্রকৌশলী এবং একটি ডিজাইন ও সুপারভিশন ফার্ম নিয়োজিত রয়েছে। প্রকল্প কার্যক্রমের তদারকি ও তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০ জন মনিটরিং অফিসার ও সিনিয়র বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল কাজ করছে। সেখানে ১০ জনের মতো নারী রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে আমরা নারীদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। যা দেশের অর্থনীতিসহ উৎপাদনশীলতা কার্যক্রমে অবদান রাখছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিগত এক যুগে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রায় ৯২ লাখ কৃষক, খামারি, যুব ও যুব মহিলা এবং প্রান্তিক কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানরে সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে খামারিদের সংগঠিত করে ৫ হাজার ৫০০ প্রোডিউসার গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। এসব গ্রুপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী খামারি আন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। লাইভস্টক ফারমার্স ফিল্ড স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রকল্পের আওতায় এসব খামারিদের উন্নত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান ও উপকরণ সহায়তা প্রদান  করা হচ্ছে। প্রোডিউসার গ্রুপে সম্পৃ্ক্ত খামারিরা তাদের উৎপাদিত সামগ্রী সরাসরি যাতে বিপণন ব্যবস্থায় সংযুক্ত করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার ও ডেইরি হাব স্থাপনের মাধ্যম প্রান্তিক খামারিদের সহজেই আধুনিক সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত করা হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদিত দুধ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণে যাতে প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহার করতে পারে সে জন্য এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় মিল্ক কুলিং সেন্টার ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হচ্ছে। এলডিডিপি প্রকল্পের এসব কার্যক্রম একদিকে যেমন উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।  

এলডিডিপিতে নারীর সম্পৃক্ততা: প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিটে (পিএমইউ) কর্মরত ৪৩ জন এরমধ্যে নারী ১২ জন অর্থ্যাৎ ২৮ শতাংশ। এলইও-তে মোট ৪৬৫ জন নারী ১৪৯ জন ৩২ শতাংশ। লাইভস্টক ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ড (এলএফএ) ৯৩০ জন নারী ৩০৫ জন ৩৩ শতাংশ। লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার ( এলএসপি) হিসেবে রয়েছে  ৪২০০ জন এরমধ্যমে নারী ১৪২৫ জন বা ৩৪ শতাংশ। অফিসার পদে ১৭১০ জন নারী ৩৫০ জন বা ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফিল্ড ষ্টাফ ২৩৬২ জন নারী ২৭৭ জন বা শতাংশ হিসেবে ১২ শতাংশ। জিআরএম প্রশিক্ষণ ৫৯ জন এরমধ্যে নারী ২ জন বা এক দশমিক ৬৯ শতাংশ। জেন্ডার প্রশিক্ষণ ২০ জন নারী ৯ জন বা ৪৫ শতাংশ। ডিওয়ার্মিং প্রোগ্রাম (পরিবার) ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৭১ জন এরমধ্যে নারী এক লাখ ১৩ হাজার ৩৯৩ জন বা ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সিইআরসি জরুরি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে ৪ লাখ এক হাজার ৯৬৭ জনকে এরমধ্যে ৬৮ হাজার ১৫৩ জন নারী বা ১৭ শতাংশ নারী।

উল্লেখ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, সুস্বাস্থ্য, মেধাবী জাতি গঠন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় উন্নত ও মানসম্পন্ন প্রাণিসম্পদের ভূমিকা অসামান্য । দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে তাই সরকার বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাস্তাবায়ন করছে পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৯-২০২৩) প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)। দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের সর্ববৃহৎ এ উন্নয়ন প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এ প্রকল্পটি দেশের ৬১টি জেলার ৪৬৫টি উপজেলায় (৩টি পার্বত্য জেলা ও উপজেলা ব্যতীত) বাস্তবায়ন করছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো প্রাণিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মার্কেট লিংকেজ ও ভ্যালু চেইন সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি থামারিদের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, নিরাপদ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন।

বাংলাদেশ সময়: ২৩২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২২
জিসিজি/এসএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।