ঢাকা: বর্তমানে দেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেন। বাকি ৫০ শতাংশ করেন বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে।
রোববার (৪ ডিসেম্বর) অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে তাদের ভূমিকা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বক্তারা।
জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ওজিএসবি।
সংবাদ সম্মেলনে আলোচকরা বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে সন্তান প্রসবের সময় প্রতি এক লাখে ৫০০ জন মা মৃত্যুবরণ করতো। বর্তমানে এই সংখ্যা ১৬৭ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই মাতৃ মৃত্যুহার আরো কমে ৭০ জনে নেমে আসুক।
তারা আরো বলেন, মা ও শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে বাড়িতে ডেলিভারি করানো। বাড়িতে ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মায়েদের রক্তক্ষরণ ও খিচুনি হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে অনেক সময় মা ও শিশুর মৃত্যু হয়। আবার অনেক সময় তাদের এমন অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয় যে, তখন আর ডাক্তারদের কিছু করার থাকে না।
তিনটি কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি শতভাগ নিশ্চিত সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম।
সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে আসা মায়েদের অধিকার। কিন্তু এ অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থ সংকট ও পরিবারের সদস্যদের অনিচ্ছা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দক্ষ জনবলের অভাব।
তিনি আরো বলেন, সন্তান জন্মের সময় মায়েদের মৃত্যুর ঘটনাকে এখনো আমাদের সমাজে স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। এ জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গর্ভাবস্থায় নারীদের ৮ বার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ৪৭ শতাংশ নারী মাত্র ৪ বার চিকিৎসকের কাছে আসেন। এ বিষয়ে নারীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। আর এ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ চিকিৎসক আরও বলেন, ‘মিজোপ্রোসটন’ নামের একটি ট্যাবলেট আছে। সন্তান প্রসবের পর মায়েদের এ ট্যাবলেট তিনটি খাওয়ালে রক্তক্ষরণ কমে যাবে। এছাড়া খিচুনির জন্য একটি ইনজেকশন আছে। সেটা ব্যবহার করলে খিচুনি হবে না। নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নে আমাদের এসব দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
সংগঠনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে যাতে গর্ভবতী মায়েরা স্বাস্থ্যসেবা পান সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ৮ হাজার মিড ওয়াইফ প্রশিক্ষণ নিয়ে বসে আছে। এখন শুধু তাদের কাজে লাগাতে হবে।
নারী স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পরিবার পরিকল্পনা করতে হবে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হয়। প্রতি তিনজনে একজন নারী সন্তান গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকেন না। এতে নারী স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটি আমাদের দূর করতে হবে। বর্তমানে আমাদের প্রতি দম্পতিতে সন্তান জন্মহার ২ দশমিক ২ শতাংশ। এটিকে ২ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এ জন্য কনডম ব্যবহারসহ বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, আমাদের দেশে এখনো নারীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। নারীদের জীবনের মূল্য দেওয়া হয় না। এ ধরনের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে মা ও শিশুর মৃত্যু হার কমানো সম্ভব হবে না।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী, সংগঠনের যুগ্ম সচিব অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা, অধ্যাপক সালেহ বেগম চৌধুরী ও অধ্যাপক এস কে জিন্নাত আরা নাসরিন।
ওজিএসবি বাংলাদেশের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের একটি অলাভজনক সংগঠন। নারী শিক্ষা, সেবা, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সামাজিক দায়িত্ব অর্থাৎ মেয়েদের সব প্রকার সেবামূলক কাজ ওজিএসবি করে থাকে।
নারী স্বাস্থের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর ১৮টি শাখা আছে এবং এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৬০০। সংগঠনটি বিভিন্ন দেশি বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মা ও শিশু মৃত্যু হার কমাতে নিরলসভাবে কাজ করছে। দেশে মাতৃ মৃত্যু হার কমানোর পেছনে এ সংগঠনের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২২
এসসি/জেএইচ