ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গণহত্যার স্বীকৃতি ও বুদ্ধিজীবীদের জানার মাধ্যমে ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২
গণহত্যার স্বীকৃতি ও বুদ্ধিজীবীদের জানার মাধ্যমে ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে

রায়ের বাজার (ঢাকা): বিজয়ের ঊষালগ্নে পরাজয় অত্যাসন্ন জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের হত্যায় মেতে ওঠে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করা। স্বাধীনতা পেয়েও বাঙালি জাতি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই নীল নকশা বাস্তবায়ন করাই ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার হীন উদ্দেশ্য। আর তাই এই দিনে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানো, তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশসহ বিদেশে পলাতক থাকা আসামিদের দেশে এনে রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন শহীদদের স্বজনসহ সংশ্লিষ্টরা।

বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে কথা হয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীবের সঙ্গে। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকেই এখনো দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন। তাদের দ্রুত ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে। এজন্য কূটনৈতিকসহ অন্যান্য তৎপরতা বাড়াতে হবে।

শহীদ শিহাব উদ্দিন শেখের সন্তান শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হওয়ায় স্বস্তি বোধ করছি। তবে এখনো পলাতক রয়েছে অনেকে। তাদের অস্তিত্ব লালন-পালন করছেন অনেকে। এ অপসংস্কৃতির মানুষগুলোকে রুখে দেওয়া ও তাদের সঠিক বিচার আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ।

শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে ও ‘প্রজন্ম ৭১’র সভাপতি আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে আনুষ্ঠানিকভাবে দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে জানানো হয়নি। জাতি জানতে চায়, সরকার কেন তাদের ফিরিয়ে আনতে পারল না?

তিনি বলেন, দেশের মুক্তির জন্য রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ও বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে রায় সম্পন্ন করতে হবে। যারা এদেশ এনে দিয়েছেন, তাদের সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি করে জানাতে হবে। না জানলে কী করে নতুন প্রজন্ম জাতির হাল ধরবে!

শহীদ সৈয়দ মোর্শেদ আলীর সন্তান তাহমিনা খান বলেন, ১৪ ডিসেম্বরের বীভৎসতার স্বীকৃতি আমাদের দাবি। স্বজনদের রক্তের দাবি আমরা ছাড়ব না। সেই গণহত্যার কথা পৃথিবীতে তুলে ধরুন। পরবর্তী প্রজন্মও যেন এই দাবিতে সোচ্চার থাকে।

এসব বিষয়ে কথা হলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জানান, সমগ্র পৃথিবীর গণহত্যা বিষয়ক চিন্তাচর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ক চিন্তাচর্চার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সঙ্গে গত শতকের অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার মিল ও অমিল রয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের গণহত্যা বৈশ্বিক ইতিহাসেরও অংশ। গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আমাদের যে লড়াই তাকে বেগবান করতে আমরা কাজ করছি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি আছে। কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ১৫০০ বুদ্ধিজীবীর তালিকা আমরা করেছি। এছাড়া নতুনভাবে আরও ১০০ আবেদন জমা পড়েছে। আশা করছি ২৬ মার্চের আগে বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে।

অন্যদিকে বিদেশে পলাতক থাকা আসামিদের দ্রুত ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে সরকারের স্বদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ঘাতটি নেই বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, যারা দেশের বাইরে আছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে। বিদেশে অনেক আইনি প্রতিবন্ধকতা আছে। তারপরও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। অচিরেই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছি। কারো কারো বিষয়ে অগ্রগতিও হয়েছে। আশা করি এ প্রক্রিয়া আমরা দ্রুত সম্পন্ন করতে পারব।

 

এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জানার মধ্যেই আমাদের মুক্তি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, প্রতি বছর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করে জাতির সূর্য সন্তানদের স্মরণ করি। আমরা তাদের হয়তো আর ফিরে পাবো না। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ, চেতনা, চিন্তার বিকাশ আমাদের ধারণ করতে হয়। পূর্বসূরিদের চেতনা অনুসরণ করেই আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হয়। তাদের অনুপ্রেরণা নিয়েই আমাদের পথচলা। তাদের হারিয়ে বাঙালি জাতি বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি কখনই পূরণ হবে না। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

উল্লেখ্য, একাত্তরের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) বিভিন্ন এলাকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হল, রায়ের বাজারের নদীর তীর ও মিরপুরের কয়েকটি স্থানে। ডা. ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ঢাবি শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর, মনসুর আলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় এসময়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে কারণে জীবন দিয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও দর্শন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কেননা তারা অত্যন্ত মানবিক, উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২
এইচএমএস/এমএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।