ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাবার লাশটা পেলে কষ্ট কম হতো

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২২
বাবার লাশটা পেলে কষ্ট কম হতো

খুলনা: ৫২ বছর ধরে বুকে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। বিজয়ের ঠিক পূর্বক্ষণে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর খুলনার রূপসা ঘাট থেকে পাকিস্তানী সেনারা এদেশের রাজাকার আল-বদরদের সহযোগিতায় আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোক্তার হোসেন দাঁড়িয়াকে ধরে নিয়ে যায়।

তারপর আমরা তার লাশ খুঁজে পাইনি। বাবার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের সবার ধারণা খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমিতে তাকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অজস্র লাশের সঙ্গে হয়তো তার লাশও মিশে গেছে।

বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) এক স্বাক্ষাৎকারে বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোক্তার হোসেনের ছেলে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ও মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মো. মফিদুল ইসলাম টুটুল।

বাবাকে হারানোর ঘটনা বর্ণনা করে টুটুল বলেন, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া অঞ্চল স্বাধীন ঘোষিত হয়। আমার বাবা মোক্তার হোসেন খুলনার দিকে রওয়ানা হন। ১২ ডিসেম্বর রূপসা নদীর পূর্বপাড়ে তার পরিচিত হক সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। সারারাত বাংলাদেশের পতাকাসহ বিজয় উৎসব পালনের জন্য নানা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৩ ডিসেম্বর সকালে নৌকায় করে রূপসা নদী পার হয়ে খুলনা ঘাটে নামা মাত্রই রাজাকার জয়নাল পাকসেনাদের ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দেন আওয়ামী লীগ নেতা মোক্তার হোসেনকে। মোক্তার হোসেনের সঙ্গে আরও যারা ছিলেন তাদের তাড়িয়ে দিয়ে মোক্তার হোসেনের দু'হাত এবং চোখ বেঁধে পাকসেনারা তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যান। গ্রামের বাড়িতে পরিবারের কাছে এ খবর পৌঁছালে ১৭ ডিসেম্বর পরিবারের লোকজন খুলনায় এসে অনেক চেষ্টা করেও মোক্তার হোসেনের কোনো সন্ধান পায়নি। তার প্রতিষ্ঠানের অধীন সরকারি চলমান কাজের বিল, ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ, লকারে গচ্ছিত গহনা সর্বস্ব হারিয়ে পরিবারটি খুবই অসহায় দিনাতিপাত করছিল। তবে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শহীদ পরিবারগুলোর দুই হাজার টাকার অনুদান পেয়েছিলাম আমরা। আমার দুই বোন মাহফুজা খানম কচি ও মাকসুদা আক্তার রুনু। বাবা হারানো আমাদের কাছে বাবা মানে দেওয়ালে লাগানো একটি ছবি আর লাল-সবুজের এ বাংলাদেশ। বাবা হারানোর পর অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা করে মা আমাদের বড় করেছেন। ২০০৭ সালে ব্রেন স্টোক করে অর্থের অভাবে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মা মারা যান। আজ যে লাল-সবুজের পতাকা, মানচিত্র নিয়ে গর্ব করি যেখানে কিছুটা অবদান আমার বাবারও রয়েছে। এ কথা ভাবতে গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তবে তাদের যে প্রত্যাশা ছিল তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

আক্ষেপ করে করে ব্যবসায়ী নেতা টুটুল বলেন, আমার বাবার হত্যাকারী যারা ছিল তারাও এদেশে বসবাস করছেন। আমরা চাই এসব ঘাতকদের বিচার হোক। আমার বাবার লাশ পেলে আমাদের কষ্ট কম হতো। ৫২ বছর ধরে জানতে পারলাম না আমার বাবাকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। যার যায় সেই বোঝে হারানোর বেদনা।

মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, মোক্তার হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্নের সঙ্গে এক হয়ে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৩৪ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশকে স্বাধীন করতে হবে, দেশের মানুষের মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার সার্বক্ষণিক দর্শন। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আশুতিয়া গ্রামের ছাহার উদ্দিন দাড়িয়া ও সামেত্য বেগমের বড় ছেলে ছিলেন মোক্তার হোসেন। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে বড় এবং সংসারের উপার্জন সক্ষম ছিলেন তিনি। চাকরি ও ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথমে খুলনা শিপইয়ার্ডে, এরপরে বিজিএমসিতে চাকরির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন খুলনা আওয়ামী লীগের নেতা শেখ আব্দুল আজিজ, শেখ সালাউদ্দিন ইউসুফ, এম এ বারিসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ছয় দফা বাস্তবায়নে বাবার ভূমিকা প্রসঙ্গে টুটুল বলেন, মোক্তার হোসেন বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ১৯৬৬ সালের এর ছয় দফা বাস্তবায়নে নানা ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন গণসংযোগ, সমাবেশ, মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খুলনা শহরের মহাসিনাবাদ ইউনিয়নের নতুন বাজার অঞ্চলে বসবাস করতেন। একপর্যায়ে তিনি মহাসিনা বাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। এছাড়া শহর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা থেকেও বাদ পড়েনি তার নাম। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের এতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তিনি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। একসময়ে চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতি এবং ঠিকাদারি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি কেননা মুক্তিযুদ্ধের বেসরকারি শহীদদের গেজেটে শহীদ মোক্তার হোসেনের নামও রয়েছে। গোপালগঞ্জ স্টেডিয়ামের পাশে শহীদ স্মৃতিস্তম্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোক্তার হোসেনের নাম উল্লেখ রয়েছে। শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গোপালগঞ্জ জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর হতে শহীদ মোক্তার হোসেন স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।

 

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২২
এমআরএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।