ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম দিয়ে শুরুর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনা পর্যন্ত সারা জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৫৪ বছরের জীবনে তিনি চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তাঁর মোট জীবনের সিকিভাগ।
তাঁর বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, কারাগারে থাকার কারণে তাঁর ছোট ভাই-বোনরা বাবার সংস্পর্শ খুব কমই পেয়েছিল।
ভাই শেখ কামালের একটি ঘটনা শেখ হাসিনা লিখেছেন (তাঁর ভাষায়), 'শেখ কামাল আব্বাকে কখনও দেখে নাই, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। ও হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলে ডাকি। ' (শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, বইমেলা-২০১৫, পৃষ্ঠা-৩০)
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন কিভাবে কাটত, এটা নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও লিখিত আছে ইতিহাসের পাতায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের জেলজীবন নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে, 'মওলানা (ভাসানী) সাহেবের সঙ্গে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের বাঁধা নিয়ম ছিল। ' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৬৯)
কারাগারের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রথম পরিচয় ১৯৩৮ সালে, যখন তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র, তাও আবার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ সফরে আসবেন, সঙ্গে শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হবে। দায়িত্ব পড়ল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি তাঁর সমবয়সী হিন্দু, মুসলমান সবাইকে নিয়ে গঠন করলেন বেশ বড় একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কদিন পরে দেখা গেল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকরা কেটে পড়ছে। জানা গেল, তাদের কংগ্রেস থেকে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, সুতরাং তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া যাবে না। এই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয় এবং রমাপদ দত্ত নামের একজন ছুরিকাহত হন। শেখ মুজিব ও অন্য মুসলমান ছাত্রদের নামে হত্যা মামলা হয় এবং শেখ মুজিবসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সেই মামলা থেকে শেখ মুজিব খালাস পান। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের শুরুতেই এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
১৯৫০ সালে ফরিদপুর জেলার জেলখানার স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে আমার দেখা হবার উপায় নেই। জেল বেশি বড় না হলেও তারা যেখানে থাকে সেখান থেকে দেখাশোনা হওয়ার উপায় নাই। আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি। ’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১৮০)
জেলজীবন সম্পর্কিত একটি ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর মহান আল্লাহর ওপর অগাধ আস্থার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্থাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউ নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯১)। এভাবেই কোরআন পাঠ ও নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন কাটে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২২
এফআর