নোয়াখালী: প্রবাসী অধ্যুষিত নোয়াখালী জেলায় সরকারি ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যখাতে তৃণমূলে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এখনও শক্তিশালী চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এর অন্যতম কারণ, একদিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব; অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোয় দালাল চক্রের দৌরাত্ম।
সরকারি-বেসরকারি সবার সঙ্গে সমন্বয় করে জেলার তৃণমূল পর্যায় ও উপকূলীয় অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিশেষ করে প্রচার-প্রচারণায় জোর দিতে হবে। পাশাপাশি যে উদ্যোগগুলো ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আরও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে মাঠে প্রয়োগ করলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হবে।
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং শীর্ষ পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় নোয়াখালীর ভূমিকা স্বীকৃত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৪ হাজার ২০২ বর্গ কিলোমিটার। জেলায় নয়টি উপজেলা, ৮টি পৌরসভা রয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী নোয়াখালী জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ।
এই বিশাল জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের বসবাস গ্রাম ও উপকূলীয় জনপদে। এখানে মানুষের মাঝে এখনো শিক্ষা ও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যের বিষয়ে উদাসীন। তারা সচেতনতার অভাবে রোগের অবস্থান জটিল পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ডাক্তার ও চিকিৎসার শরণাপন্ন হন। তখন অনেক সময় আর কিছুই করার থাকে না। সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও শুধুমাত্র শিক্ষা সচেতনতার অভাবে মানুষ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
বড় ধরনের চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য জেলার একমাত্র ভরসার জায়গা ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে সরজমিনে দেখা যায়, শয্যা সংখ্যার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে দ্বিগুণ প্রায় ৫ শতাধিকের ওপর রোগী ভর্তি থাকে। এছাড়া জেনারেল হাসপাতালে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। যা রোগী অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য জনবল কম থাকায় রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে মেঝে ও বারান্দায় বিছানা পেতে থাকতে হচ্ছে।
মূলত সরকারি এ হাসপাতালে গ্রাম অঞ্চলের অসহায়, দরিদ্র ও অসচেতন মানুষরাই চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। আর এই অসচেতনতাকে পুঁজি করে দালাল চক্রের দৌরাত্মে কিছু চিকিৎসক উন্নতমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলে রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা জন্য পাঠাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ভিতরে বাহিরে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন।
নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সূত্র জানায়, কমিউনিটি ক্লিনিক ৩০০টি, সিএইচসিপির সংখ্যা ২৭১টি, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক একটি, শুধুমাত্র মাইজদি ও বেগমগঞ্জে স্কুল হেলথ ক্লিনিক ২টি, প্রত্যন্ত এলাকা চর আলগীতে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল একটি। এর বিপরীতে সরকারি চিকিৎসকের মোট পদ সংখ্যা ২৫৯টি। এরমধ্যে এখনো ৯৭টি পদ শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ ২৩৬টি, শূন্য রয়েছে ৪২টি। এছাড়া বৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ১৮২টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১২৮টি, ডেন্টাল ক্লিনিক ১২টি।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন কৈশোর জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের উপর জোর দিয়েছে। গত এক যুগেরও অধিক সময় ধরে তৃণমূলে সরকারি নানা উদ্যোগ ও সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে তৃণমূলের পিছিয়ে পড়া জনগণ উপকৃত হচ্ছে। তবে সরকার প্রদত্ত ওষুধ প্রদানের বিষয়ে অনেকের অভিযোগ রয়েছে বলে জনা গেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আরও মনিটরিং প্রয়োজন।
জেলা রোভার স্কাউটসের সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোসেন ধনু জানান, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় টিকা ক্রয় ও টিকাদান কার্যক্রম খুবই কার্যকর এবং উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। তবে প্রথম দিকে নোয়াখালী জেলায় টিকা দান কার্যক্রমে মানুষের আগ্রহ কম থাকলেও পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং গণটিকা কার্যক্রমে লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে জেলায় টিকাদান কর্মসূচি প্রশংসিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার সার্বিক স্বাস্থ্য সেবায় উন্নতির জন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এটি আরও কার্যকর হয়ে উঠবে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী জানান, শিক্ষিত জনগণ বর্তমানে স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক সচেতন। বর্তমান ডিজিটাল সরকারের সরকারের তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারও এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া গ্রামের সাধারণ জনগণ এখনও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নয়। তাদের সচেতন করতে আমরা মাঠ পর্যায়ে নানা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে আসছি। এরমধ্যে, ভিটামিন এ-প্লাস, কোভিড-১৯, এম আর, কৃমি সপ্তাহ, ক্ষুদে ডাক্তার, ডেঙ্গু, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি। আমরা আশাকরি এসব ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে একটি কার্যকর সেবা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
জেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী মো. রফিক উল্যাহ জানান, নোয়াখালী জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি। এক্সরে মেশিনসহ কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও প্রায়ই নষ্ট বা অকেজো থাকে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মতৎপরতা ও সেবায় আরও উন্নতি ও আধুনিক করা প্রয়োজন। মা ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে। এখানে শিশুদের টিকা দেওয়াসহ অন্যান্য সেবা দেয়া হয়। স্কুল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ নিয়ে কাজ করে তেমন কোনো তথ্য জানা নেই জনগণের। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে আরও গতি নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। ঘরে ঘরে যাওয়ার উদ্যোগকে আরও জোরালো করতে হবে। সংক্রামক রোগ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে আলাদা উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এতে একটা কার্যকর স্বাস্থ্য সেবার বলয় গড়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসরাত সাদমীন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগ এবং গ্রামের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা। এ উপজেলার কোথাও এখন আর বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসব করানো হয় না। যার কারণে মাতৃমৃত্যু শূন্যের কোটায় এবং শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নেমে এসেছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রগুলো হয়ে উঠেছে প্রসূতিদের ভরসাস্থল। সেখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে সার্বক্ষণিক প্রসব সেবা নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে উপজেলাটিকে ‘শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিতকরণ মডেল উপজেলা’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই মডেল যদি পুরো জেলার ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি এর সুফল পাবে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, বর্তমান সরকারের গত ১৪ বছরের ক্ষমতাকালীন দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আলোকে সরকারের নানা উদ্যোগ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্য বিভাগ সমৃদ্ধিশালী। তবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সচেতনতার সেবা প্রদান এখনও শতভাগ কার্যকর হয়ে ওঠেনি। নোয়াখালীতেও একই চিত্র দৃশ্যমান। যেহেতু এ জেলার অর্ধেক হচ্ছে, চর ও উপকূলীয় অঞ্চল। তবে আমরা হতাশ নই, বর্তমান ডিজিটাল বান্ধব সরকারের তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেলার ৯১টি ইউনিয়নকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করছি। আশাকরি, এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে মানুষ আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমরা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করছি। প্রতিটি মাসিক সমন্বয় সভায় জেলায় স্বাস্থ্য সেবার সাফল্য-ব্যর্থতা সব গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়। সরকারি বেসরকারি সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এরই আলোকে জেলার স্বাস্থ্য সেবায় আরও গতিশীল ও কার্যকর করতে তৃণমূলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উৎসাহিত করি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার পাশাপাশি নোয়াখালী জেলায় উন্নত ও কার্যকর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, শূন্যপদে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানসহ জনবল দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। সর্ব সাধারণের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালুর ব্যবস্থাসহ সবার আগে অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখা উচিত। সরকারি-বেসরকারি সবার সাথে সমন্বয় করেই স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে হবে। এ ছাড়া যা আছে সেগুলো সঠিক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি যে উদ্যোগগুলো ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আরও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা ডিসেম্বর ২২, ২০২২
এমজে