ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গহীন পাহাড়ে অপরাধীদের আস্তানায় আধুনিক প্রযুক্তি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২২
গহীন পাহাড়ে অপরাধীদের আস্তানায় আধুনিক প্রযুক্তি

কক্সবাজার: একদিকে সাগর, অন্যদিকে পাহাড়। কক্সবাজারের গহীন পাহাড়ের ধাপে ধাপে রয়েছে অসংখ্য গুহা।

এসব গুহায় অপরাধের আখড়া গড়ে তুলেছে সশস্ত্র অপরাধী চক্রের সদস্যরা। এসব গুহা পরিচালিত হয় আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। আছে ভারী অস্ত্রও। এসবের মাধ্যমে অপরাধীরা অপহরণসহ নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে বহুদিন ধরে।

সম্প্রতি ৮ ব্যক্তি পাহাড়ের একটি চক্রের সদস্যদের হাতে অপহৃত হন। ঘটনার পর দীর্ঘদিন অপহৃতদের আটকে রেখে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। পরে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা পণ নিয়ে তাদের মুক্ত করে দেয় চক্রের সদস্যরা।

বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম। এ সময় অপহরণের শিকার ওই ৮ ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার বলেন, অপহরণের শিকার এসব ব্যক্তিরা পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। ওই খাল থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার ভেতরে রয়েছে গুহা। এসব গুহায় নিজের অপরাধ পরিচালনা করে কিছু বাংলাদেশি। তাদের সহায়তা করে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা। গহীন পাহাড়ে অপরাধের নেটওয়ার্ক পরিচালনায় তারা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে।

তিনি জানান, চক্রের প্রধানদের কাছে আধুনিক ল্যাপটপ, ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সর্বাধুনিক ডিভাইস রয়েছে। তাদের হাতে রয়েছে ভারী অস্ত্র। তারা অপহরণের ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, সেসবও জেনে নেয় চক্রের সদস্যরা। টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহৃত ৮ ব্যক্তি ফিরে আসার পর তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, বুধবার (২১ ডিসেম্বর) রাত ২টার দিকে অপহরণের শিকার ব্যক্তিরা নিজ নিজ বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফিরলেও স্বজনদের সঙ্গে তারা খুব কম সময় কথা বলতে পেরেছেন। কারণ, ফেরার খবর পেয়ে তাদের দ্রুত নিজেদের হেফজতে নেয় পুলিশ। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তারা (ভুক্তভোগী) পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। জানিয়েছেন, ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন তারা।

কীভাবে ঘটে অপহরণের ঘটনা
গত রোববার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার একটি পাহাড়ের ভেতর খালে মাছ ধরতে যান অপহরণের শিকার হওয়া টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রশিদ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, তার ভাই করিম উল্লাহ, মমতাজ মিয়ার ছেলে মো রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সলিম উল্লাহ, কাদের হোসেন ছেলে নুরুল হক, রশিদ আহমদের ছেলে নুরুল আবছার ও নুরুল হকের ছেলে নুর মোহাম্মদ। পাহাড়ের অপরাধীরা এক কলেজছাত্রসহ তাদের সবাইকে অস্ত্রের মুখে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে তাদের স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে অপহরণকারীরা। এ সময় মোটা দাগে মুক্তিপণ চাওয়া হয় স্বজনদের কাছে।

অপহরণের শিকার ৮ জন।  ছবি: সংগৃহীতযা জানা গেল ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে
দুপুরে অপহরণের ঘটনা নিয়ে আলাপ হলে ভুক্তভোগী মোস্তফা ও করিমের (অপহৃত) বড় ভাই মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, তারা পাহাড়ের অপরাধীদের হাতে ভারী অস্ত্র দেখেছেন। ২০ থেকে ২৫ জনকে তারা দেখেছেন। তবে, অপরাধীদের সংখ্যা আরও বেশি। পাহাড়ের বিভিন্ন গুহায় আলাদা করে রাখা হয়েছিল তাদের। যারা তাদের অস্ত্রের মুখে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের তিনজন ছাড়া বাকিরা মুখোশ পরে থাকতেন। যাদের মুখোশ ছিল না তারা রোহিঙ্গা। মুখোশ পরিহিতরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। চক্রের প্রধানকে তারা ‘মেজর’ বলে ডাকে। তারা সবাই বাংলাদেশি।

তারা আরও জানান, গহীন পাহাড়ের গুহায় অপহরণকারী ও চক্রের প্রধানগণ ল্যাপটপ ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ডিভাইস ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে তারা দেশের গণমাধ্যম ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ওপর নজরদারি করে। আগাম কোনো তথ্য পেলে তারা একে অপরকে জানিয়ে দেয়।

অপহরণের এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলার বাদি মোস্তফা ও করিমের অপর ভাই হাবিব উল্লাহ। তিনি বলেন, ভাইদের ফেরার পর তাদের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য তিনি পেয়েছেন তাতে বোঝা যায়, গহীন পাহাড়ে অপরাধীদের খাবার সরবরাহে বয়স্ক এক ব্যক্তি কাজ করেন। তিনি মাঝে মধ্যে রান্না করা খাবার নিয়ে যান। আবার মাঝে মাঝে উপকরণ নিয়ে গিয়ে পাহাড়েই রান্না করেন। কেউ যাতে পাহাড়ে ধোঁয়া দেখতে না পায়, যে জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে যাওয়া হতো বেশিরভাগ সময়। অপহরণকারীরা ওই ব্যক্তিকে বাবা বলে ডাকে।

হাবিব জানান, অপহরণের ঘটনার পর দায়েরকৃত মামলায় আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ে অভিযান চালায়। তারা প্রায় অপরাধীদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে তার ধারণা। অপহরণের শিকার তিনজনকে নিয়ে পুলিশের অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না।

অপহরণের শিকার হওয়া নুরুল আবছার জানিয়েছেন, তাদের গুহায় রাখার সময় পুলিশ যে অভিযান পরিচালনা করে, তাতে অপরাধীরা ঘাবড়ে গিয়েছিল। পরে তাকেসহ দুজনকে আটকে রেখে ছয়জনকে টাকা আনতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। রাতের মধ্যে টাকা না দিলে বন্দী রাখাদের মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

আবছার বলেন, যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা নিজেদের ও আমাদের পরিবার কাছ থেকে মোট ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে পাহাড়ে আসেন। পরে আমাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বাহাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের সঙ্গে অপহরণের বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে অপরাধী কোনো চক্র রয়েছে, যাদের অবস্থান বেশ শক্ত। গত ৫ মাসে তারা বাহারছড়া ইউনিয়নের ১৫-২০ জনকে অপহরণ করে। তাদের দমনে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযানের দাবি করেন তিনি।

ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, অপহৃতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যার ওপর ভিত্তি করে তারা পাহাড়ে অভিযান শুরু করে। স্থানীয়রা তাদের যথেষ্ট সহায়তা করে। তাদের নিয়েই অপরাধীদের অবস্থান নেওয়া পাহাড় ঘিরে রাখা হয়। এতে অপরাধীরা ভয় পেয়ে অপহৃতদের ছেড়ে দেয়। ভুক্তভোগীদের নির্যাতন করা হয়েছিল। তাদের চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছে।

এ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অপরাধীরা সবাই রোহিঙ্গা নয়। চক্রের বেশিরভাগ সদস্য বাংলাদেশি। অপহরণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার ভিত্তিতে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২২
এসবি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।