ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দুর্গম পাহাড়ে নির্মিত সড়কে পাল্টে গেছে স্থানীয়দের জীবনমান

কৌশিক দাশ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
দুর্গম পাহাড়ে নির্মিত সড়কে পাল্টে গেছে স্থানীয়দের জীবনমান পাহাড়ে তৈরি সড়ক।

বান্দরবান: সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে সড়ক। ফলে পাল্টে গেছে সেই পাহাড়ি এলাকার চিত্র।

 

একসময় নদীপথে আলীকদম সদর থেকে কুরুকপাতা ইউনিয়নে যেতে যেখানে একদিন সময় লেগে যেত, সেখানে নতুন সড়ক নির্মাণের ফলে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে করে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনস্ত ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের আওতায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেটের চেয়ে ৩৫ কোটি টাকা কম খরচে নির্মিত হয়েছে নতুন এই সড়ক। ফলে এখন স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অপরিসীম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পর্যটন শিল্প বিকাশের।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম কুরুকপাতা ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আলীকদম সদর থেকে এক সময় কুরুকপাতা ইউনিয়নে যেতে হলে মাতামুহুরী নদী দিয়ে নৌকায় করে যেতে হত, আর এই দুর্গম কুরুকপাড়া ইউনিয়নে নৌকা চড়ে পৌঁছাতে যাত্রীদের সারাদিন সময় লেগে যেত। তবে সময়ের পরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে এবং পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুরের একান্ত প্রচেষ্টায় একটি নিরাপদ ও টেকসই সড়ক নির্মাণ হয়।  

২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী পর্যন্ত ৩৭.৫ কিলোমিটার কার্পেটিং সড়ক নির্মাণের জন্য ৫০৯.২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণের প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়।  

অনুমোদনের পরপরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনস্ত ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের আওতায় একটি দৃষ্টিনন্দন সড়ক নির্মাণ করে সেনাবিাহিনীর সদস্যরা।

আলীকদম জিরাপাড়ার বাসিন্দা রাম বাহাদুর ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, একসময় আমাদের আলীকদম থেকে কুরুকপাতা যাওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। জরুরি মালামাল ও সবকিছু নদীপথে বহন করে অনেক কষ্ট করে নিয়ে আসতে হতো। তবে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষা করে এখন একটি সড়ক নির্মাণ করেছে আর তাতে এখন আমরা আলীকদম সদর থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে মোটরসাইকেল অথবা যেকোন গাড়িতে নিজ বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে যেতে পারছি।

কুরুকপাতা মেননিপাড়ার বাসিন্দা জেমনি ত্রিপুরা বাংলানিউজকে জানান, এক সময় কুরুকপাতা ইউনিয়ন ছিল আলীকদম উপজেলার সবেচেয়ে দুর্গম ইউনিয়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এই এলাকার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল যে, কোনো রোগীকে আলীকদম সদর হাসপাতালে নেওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। নানা অসুখে এখানে অনেক রোগী মারা গিয়েছে আর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ইউনিয়ন ছিল অনেক পেছনে তবে এখন সড়ক হওয়ায় সব পাল্টে গেছে আর সবার আর্থসামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত হচ্ছে।

আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বাংলানিউজকে জানান, সড়ক নির্মাণ হওয়ায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ, গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, এছাড়াও কৃষিজাত পণ্যের বিপণন এবং কৃষিনির্ভর শিল্পোন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়েছে।  

তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, আলীকদম উপজেলার দুর্গম জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের ফলে অপরিসীম সম্ভাবনা জেগেছে পর্যটনের। পাশাপাশি স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনে লেগেছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার। সড়কটি নির্মাণের ফলে জরুরি চিকিৎসাসেবা পাওয়া সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় ফলমূল দ্রুত সময়ে জমি থেকে সরবরাহ করা যাচ্ছে দেশের নানান প্রান্তে।  

কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বাংলানিউজকে আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা ভাবেন। আর পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়নে দিন রাত পরিকল্পনা তৈরি করা ও শ্রম দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সেকারণে আজ আমরা পার্বত্য এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছি।

প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, সেনাবাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২২ সালের ৬ জুন মাসে সড়কটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। আর কাজ শুরুর পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেটের চেয়ে ৩৫ কোটি টাকা কম খরচে ৪৭৪.৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে এখন স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অপরিসীম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পর্যটন বিকাশের।  

জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মো. ইশরাকুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এই সড়কটিতে ৩৭.৫ কিলোমিটার কার্পেটিং রাস্তা ছাড়াও রয়েছে ১০টি ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট, ৪টি ভিউ পয়েন্ট, ক্রস ড্রেন, সাইট ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল, আর্থ ওয়টার ড্যাম, রোড সাইন। দেশের ভূ-খণ্ড রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও এই সড়ক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, পাশাপাশি সড়কটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর উন্নতির পাশাপাশি একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সুষম উন্নয়নের বাংলাদেশ গড়ার পথে বড় অর্জন।  

তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, সড়কটি নির্মাণের ফলে মুরুং, ত্রিপুরাসহ বৃহত্তর কুরুকপাতা ইউনিয়নে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবনে আর্থ-সামজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।