ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মা শুনলে কী যে খুশি হতেন

পিন্টু রঞ্জন অর্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২৪
মা শুনলে কী যে খুশি হতেন

জীবন মানেই যুদ্ধ—এটা সজীব কান্তি চাকমার চেয়ে ভালো আর কে জানে! ৪ নভেম্বর দিনটি অক্ষয় হয়ে থাকবে এই তরুণের মানসপটে। শৈশব থেকে পাওয়া অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর ঘাত-প্রতিঘাত পেছনে ফেলে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করেছেন।

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, লোকপ্রশাসন বিভাগে। আফসোস একটাই—খবরটা মাকে জানাতে পারেননি! ছলছল চোখে বলছিলেন, ‘মা শুনলে কী যে খুশি হতেন!’

মা কেন জানলেন না?
এই প্রশ্নের জবাব পেতে ফিরে যেতে হবে কুড়ি বছর আগে।

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার শিলাছড়ি গ্রামের সন্তান সজীব। তবে লোকালয়ে থাকার মতো ঘর ছিল না তাঁদের। কারণ তাঁরা যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির জেলেদের মতো ‘গরীবের মধ্যে আরো গরীব’। মা-বাবা দুজনই জুমচাষি।

মজুরিও করতেন। থাকতেন পাহাড়চূড়ায় ছোট একটি জুমঘরে। সেখানেই জন্ম সজীবের। উঁচু-নিচু বাধার পর্বত পেরোলেন পাহাড়ের সজীবপাহাড়ে সবুজের খেলা দেখে কেটেছে শৈশব।

সজীব তখন মোটে চারে পড়েছেন, হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন মা। লতাপাতার রসে সারানোর চেষ্টা চলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে সজীবকে এক পিসির কাছে রেখে তাঁর মা সন্ধ্যামালাকে নিয়ে যাওয়া হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিছুদিন পর ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে সজীব গেলেন মাকে দেখতে।

নাড়িছেঁড়া ধনকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নিলেন মা। আপেল, কমলা খাইয়ে দিলেন। সজীব তখনো জানতেন না—সেটাই মায়ের হাতে শেষ খাওয়া।
পরদিন তাঁর মাকে নিয়ে আসা হলো দাদুদের বাড়িতে। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখেন বাড়িতে অনেক মানুষ। দাদি তাঁকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন—‘সিগোন দাদা (ছোট দাদু) কেঁদো না। তোমার মা বেড়াতে গেছে। ’

—‘কোথায় বেড়াতে গেছে মা?’
—‘আকাশে!’ 

নতুন ঠিকানায়
মা আকাশের ঠিকানায়। বাবা যেন থেকেও নেই! কয়েক মাস পর নতুন সংসার পাতলেন তিনি। সেই থেকে আর কখনো বাবার বাড়িমুখো হননি সজীব! তিনি বড় হতে লাগলেন দাদু-দাদির কাছে। তাঁদের সংসারেও নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবু নাতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বলতেন, ‘যত কষ্টই হোক, পড়াশোনা ছেড়ো না দাদু। ’

লক্ষ্মীছড়ি কিন্ডারগার্টেন—সজীবের প্রথম স্কুল। তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর ভর্তি হলেন লক্ষ্মীছড়ি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দাদুকে বাঁশ বিক্রিতে সাহায্য করতেন।

কার কাছে বায়না ধরবেন?
বিজু, প্রবারণা পূর্ণিমার মতো উৎসবে মন খারাপ হয়ে যেত সজীবের। দাদুর অভাবের সংসার। তাই পূজাপার্বণে নতুন পোশাক কিনে দিতে পারতেন না। কিন্তু বন্ধুদের পরনে নতুন জামা দেখে ছোট্ট সজীবও দাদুর কাছে বায়না ধরতেন। দাদু ধমকের সুরে বলতেন, ‘পুরনো জামা পরলে কি বিজু হবে না? তোমাকে কেউ চিনবে না?’

ভীষণ মন খারাপ হতো। ভাবতেন, মা থাকলে হয়তো এমনটা হতো না—‘মায়ের কথা মনে পড়লে অঝোরে কাঁদতাম। বন্ধুদের মায়েদের দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যেত। ভাবতাম, মা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাকেও নতুন জামা কিনে দিতেন। ’

ভুল করে বসলেন
সজীব তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছেন। তত দিনে বান্দরবান কোয়ান্টাম স্কুলের খোঁজ পেলেন দাদু কালা মোহন চাকমা। তিনি বলতেন, ‘দাদু ভাই, ভালোভাবে পড়াশোনা করো। জেএসসিতে ভালো করলে কোয়ান্টামে ভর্তি হতে পারবে। সেখানে পয়সা লাগে না। ’

বিদ্যুৎ ছিল না। কুপি জ্বালিয়ে পড়তেন সজীব। ইংরেজিতে দুর্বল। আশপাশে দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। প্রাইভেট পড়বেন, সেই সামর্থ্যও নেই।

তবু মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন সজীব। কিন্তু ইংরেজিতে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তবে কোয়ান্টামে ভর্তির জন্য জেএসসিতে ভালো করার বিকল্প নেই। ইংরেজি পরীক্ষার দিন অসদুপায় অবলম্বন করতে গিয়ে বহিষ্কার হলেন। খবরটা শুনে মর্মাহত দাদু সেদিন খুব কেঁদেছিলেন।

পরে স্কুলের শিক্ষকরা সজীবকে বোঝালেন—একবার বহিষ্কার মানেই সব শেষ নয়। তুমি আবার চেষ্টা করো।

আবার শুরু করলেন
পরের বছর আবার হাজাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। জেএসসির আগে শিক্ষকরা সজীবকে স্কুলের একটা কক্ষে রেখে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ইংরেজির দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করলেন হেমন্ত বিকাশ চাকমা ও সোনামিত্র চাকমা স্যার। সেবার জেএসসিতে স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেলেন সজীব। বৃত্তিও পেলেন। ফলে নবম-দশম শ্রেণিতে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ মিলল।

রাজমিস্ত্রির সহকারী
স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে ৪০০ টাকা মজুরিতে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন সজীব। নিজের খরচ চালিয়ে দাদুর সংসারেও দিতেন। বার্ষিক পরীক্ষার পর গেলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। একটা সুতার কারখানায় মাসখানেক কাজ করে পাঁচ হাজার টাকা পেলেন। মাটি কাটার কাজও করেছেন মাসখানেক। সজীব বললেন, “ভীষণ কঠিন ছিল সেসব দিন। নতুন জুতা কেনার মতো টাকা ছিল না। তখন এক বন্ধুকে বললাম, ‘তুই আমাকে এক জোড়া জুতা কিনে দে। ’ সে কিনে দিয়েছিল। ”

জাহাজেও ছিলেন
করোনার সময় দাদুর পরিবারে শোচনীয় অবস্থা। জীবিকার তাগিদে সজীব ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম বন্দরে। বিদেশি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কাজ জুটল। দিনে ৬০০ টাকা মজুরিতে টানা ১৭ দিন কাজ করলেন। কিন্তু যার মাধ্যমে কাজ জুটেছিল, তিনি সব মেরে দিলেন!

আরেকবার বার্ষিক পরীক্ষার পর গেলেন মিরসরাইয়ে, সেখানে একটা বিদ্যুৎ প্রকল্পে মাসখানেক কাজ করেছেন। ওভারটাইম মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এসবের মধ্যেই মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫ পেয়ে এসএসসি পাস করলেন।

মেঘ কাটেনি
কলেজে ভর্তির সময় এগিয়ে এলেন লক্ষ্মীছড়ির তৎকালীন ইউএনও ইয়াছিন শিমুল। সেবার এককালীন ‘প্রিয়দর্শী চাকমা শিক্ষা বৃত্তি’ পেয়েছিলেন। এসএসসির পর ভর্তি হলেন লক্ষ্মীছড়ি সরকারি কলেজে। বাসা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কলেজ। কলেজের কাছাকাছি এক বাসায় লজিং জুটল। বললেন, ‘কলেজে বেতন দিতে না পারায় প্রিন্সিপাল অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। সবার সামনেই অঝোরে কেঁদেছিলাম। ’ পরে তাঁকে এইচএসসির ফরম পূরণের টাকা দিয়েছিল ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’।

সজীবকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শান্তানু চাকমা। এইচএসসি পরীক্ষার পর চলে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানে জুম একাডেমিতে বিনা পয়সায় কোচিংয়ের সুযোগ পেলেন। ভালোভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ঠিক আগে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অবস্থায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলেন। হলো না। শেষে সুযোগ পেলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলে ভর্তির টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল অদম্য এই তরুণকে।

তবে ভর্তি হলেও এখনো শঙ্কার মেঘ কাটেনি সজীবের। আপাতত একটা মেসে উঠেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ কিভাবে চলবে, এ নিয়ে চিন্তায় আছেন। বললেন, ‘এ পর্যন্ত আসতে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। আমৃত্যু তাদের মনে রাখব। ভবিষ্যতে আমার মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াব। ’ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।