ঢাকা, বুধবার, ১৪ মাঘ ১৪৩১, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

রোববার রাতের ভূমিকায় প্রশংসায় ভাসছেন হাসনাত

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৫
রোববার রাতের ভূমিকায় প্রশংসায় ভাসছেন হাসনাত রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষ থামাতে যান হাসনাত আব্দুল্লাহ | ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে রোববার রাতে তোপের মুখে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। সেই সময়কার একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ওই সব ভিডিও অকাতরে শেয়ার করে হাসনাত আব্দুল্লাহ প্রশংসা করছেন কেউ, আবার কেউ নিন্দামন্দ করছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাসনাত আব্দুল্লাহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি শান্ত করতে অনুরোধ জানাতে দেখা গেছে হাসনাত আব্দুল্লাহকে।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাসনাত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্রদের মধ্য থেকে হাসনাত আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে অনেকে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছেন।

আরও আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাসনাত দ্রুত কোথাও হেঁটে যাচ্ছেন। এ সময় তার হাত ধরেছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় ঠিকমতো চোখ খুলতে পারছিলেন না তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে শেয়ার দিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহর প্রশংসা করছেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংঘর্ষ থামাতে যাওয়ার ঘটনায় অনেকেই বীরোচিত পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ হাসনাত আব্দুল্লাহ নিন্দাও করেছেন।

এ বিষয়ে সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা। ঝুঁকি নিয়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করতে যাওয়াটা হাসনাতের অপরাধ হয়েছে কি না, প্রশ্ন করেছেন তিনি।

গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন, “সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর কথা শিক্ষার্থীরা শোনে নি, তাকে ‘ভুয়া’ বলেছে-ফেসবুকে অনেককেই এটা নিয়ে উল্লসিত হতে দেখা যাচ্ছে।

বেকুব কিসিমের ব্যর্থদের এই মনস্তত্ত্ব চিরন্তন। অন্যকে বিশেষ করে তিনি যদি একটু খ্যাতিমান হয়ে যান, তাকে অসম্মান করা গেলে বা তাকে অসম্মানিত হতে দেখলে, বেকুবরা পুলকিত হয়। ”

হাসনাত আবদুল্লাহ করেছেন কী প্রশ্ন তুলে গোলাম মোর্তোজা বলেন, “মাঝরাতে সংঘর্ষ চলছিল ঢাবির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের। এই সংঘর্ঘ বাঁধার কোনো দায় হাসনাত আবদুল্লাহর নয়। সে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝখানে উপস্থিত হয়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করেছে। তার জীবনের ঝুঁকি ছিল, বিক্ষুব্ধ দুই পক্ষের মাঝে তার যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারতো। এটা সে জেনে বুঝেই সেখানে গেছে, দায়িত্বশীল আচরণ করেছে।

হ্যাঁ, বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীদের সে শান্ত করতে পারেনি। কেউ কেউ তাকে আজেবাজে কথা বলেছে। তো এতে হাসনাত আবদুল্লাহর অপরাধটা কী? ঝুঁকি নিয়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করতে যাওয়াটা তার অপরাধ?”

প্রেস মিনিস্টার আরও লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আরও অনেক ছাত্রনেতা, শিক্ষক ছিলেন। তারা এগিয়ে যাননি, এগিয়ে গেছেন হাসনাত আবদুল্লাহরা। এটাই দায়িত্বশীল নেতার কাজ, যা হাসনাত আবদুল্লাহ করেছে। আপনি তাকে বাহবা না দিয়ে রসিকতা করছেন, পুলকিত হচ্ছেন। কারণ হয়তো এই যে, আপনার ভেতরে ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারের বীজ রয়ে গেছে!”

হাসনাতের সমালোচনাকারীদের একহাত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্য ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম।

তিনি লিখেছেন বলেন, “আশেপাশে এমন বহুত শত্রু আছে যারা সুযোগ পেলে খুন করে ফেলবে, এইটা জানার পরেও মবের মধ্যে ঢুকে মারামারি থামানোর কথা বলতে হ্যাডম লাগে। অন্য কেউ এই সাহস করে নাই। সাহস করেছে হাসনাত আব্দুল্লাহ। সাহসটা করার জন্যে হাসনাতকে মাথায় তুলে ফেলতে হবে, সেটা বলছি না, তবে ন্যূনতম অ্যাপ্রিশিয়েটটা অন্তত করতে শিখেন। হয়তো ফলাফল প্রত্যাশিত হয়নি কিন্তু এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারতো। সবচেয়ে বড় কথা উদ্দেশ্য সৎ ছিল। ”

সারজিস আরও লিখেছেন, “এই ছেলেটার সমস্যা হলো, এর মাথা গরম আর সবসময় গ্রেটার পার্পেপেক্টিভ চিন্তা করে। কিন্তু সত্যি এটাই যে, মাথা গরম বলেই সেই জুলাইয়ে ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজা শেষে যখন সবাই পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর ছোররা বুলেটে দিকবিদিক ছুটে যাচ্ছিলো, তখন এই ছেলেটা সর্বপ্রথম স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ওই পুলিশের দিকে দুই হাত প্রশস্ত করে এগিয়ে যায় আর বলে we are open to killed!

ঠিক যেমনিভাবে গতকাল গিয়েছিলো। এই ছেলেটাই সেই জুলাইয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে রাজাকার রাজাকার মিছিলের সামনের সারিতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, যখন অনেকেই নিজেকে সেফ জোনে রেখেছিলো। এই ছেলেটাই সর্বপ্রথম এবং একা সচিবালয়ে আনসারলীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে এবং পরবর্তীতে ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় সচিবালয় অনেকটা সুরক্ষিত হয়ে ওঠে। ”

সারজিস আরও লিখেছেন, “এই মাথা গরম ক্ষ্যাপা ছেলেটার দোষ হচ্ছে, যখনই কোথাও অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়, ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়, তখনই এ কোনো কিছু চিন্তা না করে সমাধানের জন্য ছুটে যায়। হোক সেটা ক্যাম্পাস, রাজপথ কিংবা অন্য কোথাও।

আপনারা যারা শুধু ঘরে বসে স্যোশাল মিডিয়ার ঝড় তুলতে পারেন তাদের মতো সেইফ গেম প্লে না করতে পারাটা হাসনাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ৷ কিন্তু তিক্ত সত্য এটাই যে, এই মাথা গরম স্বভাবওয়ালা ক্ষ্যাপা তরুণ প্রজন্মের কারনেই এই নতুন বাংলাদেশ।

কতজনের এখন কতরকম স্বার্থ আর ধান্ধা সেটা আমরা বুঝি, অপ্রত্যাশিত কিছু হলে এরা যে আবার গর্তে যাবে সেটাও জানি। কিন্তু দিনশেষে চোখের সামনে রক্ত আর হাজারো জীবনের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতা রক্ষা করতে হাসনাতরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আপনাদের মতো গুটিকয়েক ভন্ড, সুবিধাবাজ, কালপ্রিট কী বললো আর কী বিহেভ করলো, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। হাসিনার পোষারা এর চেয়ে কম বলেনি বা করেনি। মিনিমাম কমনসেন্স থাকলে বোঝা উচিত কারা করছে, কেন করছে। রকেট সায়েন্স না, বোঝাটা। We are Hasnat & proud to be a fellow-fighter of Hasnat। ”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসনাত আব্দুল্লাহকে আরও অনেকেই প্রশংসার ভাসাচ্ছেন। তাদেরই একজন মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ। তিনি লিখেছেন, “গতকাল জরুরি কাজে হাসনাত আব্দুল্লাহদের অফিসে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি গাজীপুর থেকে আসা শ’খানেক উত্তেজিত তরুণ বসা। হাসনাত ঠাণ্ডা মাথায় তাদের ব্রিফ করছে। তরুণদের দাবি দাওয়া নিয়ে হাসতে হাসতে কথা বলছে। তার পাঞ্চে তরুণরাও মুখের শক্তভাব কাটিয়ে হেসে উঠছে। বেশ জটিল একটা বিষয়ের সমাধান হলো হাসতে হাসতে।

এরমধ্যে চার মিনিট সময় চেয়ে নোট পাঠালাম। আমাদের আগে থেকে আরেকগ্রুপ বসে ছিল। তাদের সাথে দাঁড়িয়েই আলাপ শেষ করলেন। সালাম ও পরিচয় দিলাম। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। হাসিমুখে সমস্যা শুনল। খুব দ্রুত সেই সমস্যা সমাধানের জন্য একজনকে অ্যাসাইন করে দিল। চার মিনিটের কাজ আড়াই মিনিটে শেষ।

আরও অনেকে এসেছিলেন তাদের সমস্যা নিয়ে। একে একে কথা বললেন। পাশাপাশি সহযোদ্ধা, বন্ধু, ছোট ভাইদের সাথে দুষ্টুমি চলছে। হাসিমুখ। ইউটিউবে গান বাজার মতো করে তার মোবাইল বেজে চলছে। একের পর এক ফোন। ছোট ছোট কথায় ফোনের কাজ সারছেন। টেক্সেটের রিপ্লাই দিচ্ছেন।

কাজ শেষ করে বাংলামোটর নেমে চা খেতে খেতে ভাবছিলাম, সমস্যায় ডুবে থাকা দেশের সমস্ত মানুষ এই কয়টা ছেলের কথা ভাবে। কী এমন বয়স? জাফর ইকবালের ভাষায়, ‘এই বয়সের ছেলেরা প্রেম করবে, নাটক দেখবে, আলুটিলা পাহাড়ে ট্যুর দিবে, দোচোয়ানি খেয়ে প্রাক্তনকে গালাগাল করবে। ’ অথচ এদের দেশ চালাতে হচ্ছে।

অল্প সময়ের দেখায় হাসনাতকে আমার ভদ্র, বিনয়ী ও হাসোজ্জ্বল এক যুবক মনে হয়েছে, যে এখনো তারুণ্যের আবহে ভরপুর। সারাদিন এত এত কাজ করার পর আবার তাকে রাতে ছুটে যেতে হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মারামারি থামাতে। তাকেই যেতে হচ্ছে। কারণ দেশের কেউ কারো কথা শুনছে না। কেউ কাউকে মানছে না। এই কয়দিন আগে যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক লক্ষ্যে লড়াই করেছে, এখন তারা একে অপরকে মারছে।

সেই মারামারি থামাতে গিয়ে আহত হচ্ছেন হাসনাতরা। দেশের বড় একটা অংশের মানুষ তাদের পছন্দ করে না। যা তা বলে। বডি শেমিং করে। উঠতে বসতে গালাগাল করে।

সরকার চাপ দেয়। বিরোধীদল চাপ দেয়। আগামীতে সরকারে আসবে, তারাও চাপ দেয়। জনতার চাপ তো আছেই।

সবার সব দাবি দাওয়া এখনই চাই, দিতে হবে। অথচ দীর্ঘদিন এই মানুষগুলোর কোনো অভাব ছিল না। কোনো দাবি দাওয়া ছিল না। যেভাবে যা চলছিল তাই মেনে নিচ্ছিল।

কে জানে, কোনো এক সন্ধ্যায় বাসার ছাদে বসে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে এরা ভাববে, ‘কার জন্য এত কিছু করলাম? কেন করলাম?’ তারপর হয়তো সিমটা বন্ধ করে চলে যাবে আড়ালে।

তখনও আপার লোকেরা বলবে, এত হাজার কোটি টাকা লুট করে ওরা ঘাপটি মেরে গেছে। আর আমরা ফেসবুকে পোস্ট করব, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই; সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’। অথচ আমরা কেউ হাসনাতদের পাশে দাঁড়াব না। হাসনাতরা মাইর খেলে খুশি হবো। ”

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোববার (২৬ জানুয়ারি) রাতে উত্তেজনা শুরু হয়। দুই পক্ষের মধ্যে রাতভর ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ায় পথচারীসহ ২০ জন আহত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে এ সংঘর্ষ বাঁধে। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষ থামাতে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের সহায়তায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৫
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।