শুক্রবারের সরেজমিন, বাংলানিউজের নিয়মিত উদ্যোগ। প্রতি শুক্রবার বাংলানিউজের একটি টিম চলে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ঘটনাস্থল বা সাইটে।
ভৈরব ও আশুগঞ্জ থেকে: বছর বছর দাদন নিয়ে ভৈরব ও আশুগঞ্জের চাতাল শ্রমিকরা ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছেন। ঋণ গ্রহণ ও ঋণ পরিশোধের এক অশুভ চক্রের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন শ্রমিকরা। শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা।
‘কাম কইরাও দেনা বাড়ে, কমে না। তারপরও মলিকের দারে (কাছে) কুনো কতা কওনের চান্স পাই না। মালিকের কাচ থিক্কা (থেকে) দাদন (আগাম টাকা) নিয়া চলতে হয়। এই কইরা আমরা ঋণের তলেই পইরা আছে। ঋণ আর সুদ হয় না’ -কথাগুলো বললেন কহিনুর রাইস মিলের (চাতাল) নারী শ্রমিক আনোয়ারা (৩৫) বেগম।
ময়মনসিংহ জেলার আঠারবাড়ি গ্রামে থাকতেন আনোয়ারা বেগম। সংসারে দরিদ্রতার কারণে তিনি এখন আশুগঞ্জের চাতাল শ্রমিক। এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে প্রায় তিনবছর যাবত কাজ করছেন চাতালে।
আনোয়ারা বেগমের মতো এই চাতালে রয়েছে আরো ৪০টি পরিবার। নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে মোট এক’শ শ্রমিক কাজ করছে কহিনুর রাইস মিলে।
ধান থেকে চালে রূপান্তরের প্রতিটি ধাপেই আছে শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো শ্রম। একজন চাতাল সর্দারের অধীনে থেকেই ধান শুকানো, ধান ভাঙ্গানো, চাল করে বস্তাবোঝাইয়ের কাজ করে শ্রমিকরা। প্রতি মাঠে ৮শ’ থেকে ১ হাজার মন ধান শুকানো হয়। চাতালে এক মাঠ ধান শুকাতে ৪-৬ দিন সময় লাগে। তবে আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলে সময় বেশি লাগে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাতালে ধান শুকানোর কাজে নারী শ্রমিকরাই বেশি নিয়োজিত থাকে। এদের সঙ্গে কাজ করছে শিশুরাও। ধান মেলে দেওয়ার ২ ঘণ্টা পর সেগুলো আবার টেনে টেনে নেড়ে দেয়া হচ্ছে। এসময় শিশু শ্রমিকরা মাটিতে ছড়িয়ে থাকা ধানগুলো সলার ঝাঁড়– দিয়ে একত্রে করতে থাকে। পরিবারের সবাই একসঙ্গেই চাতালে কাজ করতে দেখা যায়।
বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত চলে এই চাতালগুলো হিসেব নিকাশ। আশুগঞ্জ চাতাল মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভৈরব ও আশুগঞ্জ মিলে মোট চার’শ চাতাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩৭টি চাতাল বন্ধ হয়ে আছে।
শ্রমিকদের মজুরি
চাতালে ধান শুকানো থেকে চাল প্রস্তুত পর্যন্ত প্রায় এক’শ শ্রমিক কাজ করে। দৈনিক একজন শ্রমিক ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পান। এক মাঠ ধান শুকানো শেষ হলে সব মিলিয়ে প্রায় ২শ’ টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয় তাদের। শিশু শ্রমিকরা কাজ করে এক মাঠ ধান তুলার পর ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে।
চাতাল শ্রমিক শিউলি বাংলানিউজকে বলেন, ‘চাতালে এক মাঠ ধান শুকাইতে থিক্কা চাইল ভাঙ্গাইতে ৭-৮ দিনও সময় লাইগা যায়। এতে আমরা মজুরি পাই মাত্র দুই’শ ট্যাকা। এই ট্যাকায় সংসার ক্যামনে চলে? এতো কাম কইরাও আমগোর অভাবের শেষ নাই। যেসুমে কুনো কামকাইজ থাহেনা হেসুমে (অমৌসুমে) মালিকের কাছে থিক্কা ঋণ নিয়া চলন লাগে। ’
আশুগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকায় অবস্থিত কহিনুর রাইস মিলের (চাতাল) ম্যানেজার জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে জানান, চাতাল শ্রমিকরা কষ্টেই জীবনযাপন করছেন। শীত আর গরম, সব সময়ে হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিচ্ছেন শ্রমিকরা। কিন্তু যে পারিশ্রমিক পায় তা দিয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন।
তিনি জানান, এবছর মাত্র ৪৭টি মাঠ তুলতে পারছি আমরা। যদি একশ’ মাঠ নেওয়া যেতো তবে কিছুটা লাভ হতো। কিন্তু কষ্ট একই হলেও পারিশ্রমকি কম।
চাতাল শ্রমিকদের পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি ২ ট্যাকা লাভ হয় তয় কে না চায় ব্যবসা করতে? আমগো এই কম মজুরি দিয়া মালিকের কুনো লাভ থাহে না।
বয়লার
শুকানোর পরে ধান সেদ্ধ করার জন্য বয়লারে ঢালা হয়। এখানে তিনটি বয়লার আছে। প্রতিটি বয়লারে দশ মন ধান সেদ্ধ করা যায়। একসঙ্গে ত্রিশ মন ধান সেদ্ধ হতে ৫-১০ মিনিট সময় লাগে।
এ প্রসঙ্গে কহিনুর রাইস মিলের (চাতাল) শ্রমিক সমন্বয়কারী সবুজ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, যদি গ্যাসের চাপ বেশি থাকে তাইলে ৫ মিনিট সময় লাগে। এক হাজার মন দান সিদ্ধ করতে ৮ থিক্কা ৯ ঘণ্টা সময় লাগে। তয় ঠিক মত গ্যাস থাহে না।
‘লোকসানের ভারে চাতাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ -উল্লেখ করে ভৈরব চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, ব্যাংক ঋণের ওপর উচ্চহারে সুদ এবং ভারত থেকে শুল্কমুক্ত নিম্ন মানের চাল আমদানি, এই দুটি কারণে আমাদের চালের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, লোকসানের বোঝা কাঁধে নিয়ে চাতাল গুটিয়ে ফেলছে অনেক মালিকরাই।
** জ্যান্ত মাছ পেতে চান, ভৈরবে চলে যান
** কয়লার অভাবে ব্যবসা অঙ্গার!
** সব থেকেও কিছু না থাকার দুঃখ ভৈরবের
** ভালো নেই ভৈরবের পাদুকা শ্রমিকরা
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারী ০৯, ২০১৫
জাতীয়
শুক্রবারের সরেজমিন
‘দাদনের ভারে পিষ্ট চাতাল জীবন’
শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।