ঢাকা: ‘রাজনীতি যদি জনগণের কল্যাণে হয়, তবে সে রাজনীতির বলি কেন আমরা খেটে খাওয়া মানুষরা? আমাদের কী অপরাধ? কেন আমাদের উপর হামলা হচ্ছে?’ দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছে এমন প্রশ্ন রেখেছেন যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুনে দগ্ধ মোশাররফ হোসেন।
শুক্রবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তদের নারকীয় পেট্রোল বোমা হামলায় ২৯ জন দগ্ধের মধ্যে মোশাররফ একজন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে শুক্রবার মধ্যরাতে কথা হয় মোশাররফের সঙ্গে। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি কাপড়ের দোকানে তিনি কাজ করেন। রূপগঞ্জের তারাইলের বিভারে তার বাড়ি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন আর দেশের রাজনীতির প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
যন্ত্রণায় কাতর মোশাররফ দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নাম না উচ্চারণ করে বলেন, ‘প্রধান দুটি দলের শিকার আমরা জনগণ। আর কত পোড়া শরীর দেখে তাদের মন শান্ত হবে। ক্ষমতার জন্য আমাদের তো কোনো লোভ নেই, তবে আমাদের গায়ে কেন পেট্রোল বোমা দিয়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে?’
মোশাররফ বলেন, একটি দোকানে কাজ করে আমি সংসার চালাই। এখন আমার পরিবারকে কে দেখবে? আমার এ অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করবো? অবরোধের বলির পাঠা কেন আমরা?
কথা বলার একপর্যায়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোশাররফকে থামিয়ে বলেন, ‘আপনি অসুস্থ্য। কথা বলায় ক্ষতি হচ্ছে। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কথা বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করুন। ’
মোশাররফ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলেন, একবারে ঘুমানোর কোন ওষুধ থাকলে আমাকে দিন ডাক্তার। এ শরীর নিয়ে আর বেঁচে থেকেই বা কী করবো?’
মোশাররফের মতো এমন প্রশ্ন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অন্য দগ্ধদেরও।
দেশের সহিংস এমন পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান চান তারা।
দগ্ধ সাঈদা ফাতিমা বলেন, আমার স্বামীর ছুটি থাকায় বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। সেটাই কাল হলো। সাঈদার স্বামী ইয়াসির আরাফাত রাজিবও ওই সময় বাসটিতে ছিলেন। পেট্রোল বোমায় দুজনই দগ্ধ হন।
সাঈদা বাংলানিউজকে বলেন, জানি না আর কত ঘটনা ঘটলে দেশে শান্তি আসবে। দগ্ধের যন্ত্রণা যদি রাজনীতিকরা বুঝতেন, তাহলে তারা শান্তির পথে আসতেন।
২০ দলীয় জোটের অবরোধের মধ্যে যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তদের নারকীয় পেট্রোল বোমা হামলায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দগ্ধ হয়েছেন ২৯ জন সাধারণ মানুষ। এদের মধ্যে নয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
শুক্রবার (২৩ জানুয়ারি) রাত সোয়া ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনে (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৪৮৮৬) পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বাসের কমপক্ষে ২৯ জন যাত্রী দগ্ধসহ মোট ৪৭ জন আহত হয়েছেন। দগ্ধরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এছাড়া আহতদের স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ঢামেক বার্ন ইউনিটের সাবেক পরিচালক ডা. সামন্তলাল সেন ও প্রফেসর সাজ্জাদ খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তিনজন নারীসহ ২৯ জন দগ্ধ রোগী পেয়েছি। এর মধ্যে নয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।
ঢামেকে কয়েকজন দগ্ধ বাংলানিউজকে বলেন, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গ্লোরি পরিবহনের বাসটি গুলিস্তান থেকে ডেমরা রোড দিয়ে নারায়গঞ্জের রূপগঞ্জে যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী কাঠেরপুল আসামাত্র রাস্তায় একটি ককটেল ফাটায়। এ সময় গাড়িটির গতি কমে যায়। তখন জানালা দিয়ে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে পুরো বাসে আগুন ধরে গেলে অধিকাংশ যাত্রীই দগ্ধ হন।
বাসটির যাত্রী জাতীয় বাস্কেটবল দলের সদস্য ও সিটি গ্রুপের কর্মকর্তা তাকদির ইসলাম সেতু জানান, গ্রামের বাড়ি যেতে তিনি গুলিস্তান থেকে বাসে উঠেছিলেন। বাসের বাম পাশে বসেছিলেন। মাতুয়াইল সড়কে কোনাপাড়াতে পৌঁছলে ডান পাশের জানালা দিয়ে একটি পেট্রোল ছোড়া হয় বাসের ভেতর। মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাসে আগুন ছড়িয়ে যায়। যাত্রীরা জানালার কাঁচ ভেঙে বের হন। এর আগে অধিকাংশ যাত্রী দগ্ধ হন।
দগ্ধ জয়নাল আবেদিন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিউমার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করি। কাজ শেষে বাসে করে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারের বাসায় যাচ্ছিলাম। কাঠেরপুল এলাকায় আসতেই হঠাৎ বাসের ভেতর কী যেনো ঢুকে পড়লো। তারপর পুরো বাসে ধাউ ধাউ করে আগুন। জানালা ভেঙ্গে আমি বের হয়েছি।
রূপগঞ্জ মুরাপারা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নাজমুল (১৯) বাংলানিউজকে জানান, তিনি পরিবারের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়াতে বিয়ের দাওয়াতে যান। ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন।
নাজমুল বলেন, হঠাৎ আগুনের একটি বস্তু জানালা দিয়ে বাসের মধ্যে এসে পড়ে। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে প্রাণ বাঁচাতে জানালা দিয়ে লাফ দেই।
আরেক যাত্রী মোশাররফ হোসেন (৩৬) জানান, তিনি বাসের ডান পাশে বসেছিলেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন কিশোর ও যুবক পেট্রোল বোমাটি ছুড়েই পালিয়ে যায়। আগুনের কারণে তাদের চেহারা দেখতে পারেননি তিনি।
অপর বাসযাত্রী আল-আমিন জানান, তিনি মেয়ে দেখার জন্য ডেমরায় যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তার দুই খালুসহ পাঁচজন ছিলেন। তার দুই খালুই দগ্ধ হন। অপর তিনজন জানালা দিয়ে লাফ দিতে গিয়ে আহত হয়েছেন।
যাত্রাবাড়ী ছাড়াও শুক্রবার রাজশাহীর পবা ও তানোরে বাসে পেট্রোল বোমায় আরও ১০ জন দগ্ধ হয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ১৮তম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে কমপক্ষে ৪০ জন দগ্ধ হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৫