ঢাকা: এ বছরের বিশ্ব ইজেতমার প্রথম পর্ব মোনাজাতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। মোনাজাতে বিশ্বশান্তি ও মুসলিম উম্মাহর সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।
রোববার সকাল ১১টা ২০ মিনিটে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে মোনাজাত শুরু এবং ১১টা ৪৮ মিনিটে শেষ হয়। এর মাধ্যমেই শেষ হয় প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত।
প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে ভারতের মাওলানা সা’দ। এ সময় মাঠে উপস্থিত লাখো মুসল্লি দুহাত তুলে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দফতর এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে থেকে মোনাজাতে অংশ নেন।
এর চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ১৮ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে ওই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে।
এদিকে, রোববার তুরাগতীরে মোনাজাত শুরু হওয়ার পর যে যেখানে ছিলেন, তারা দুহাত তুলে মোনাজাতে অংশ নেন। ইজতেমা মাঠ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থানকারীরাও হাত তুলে মোনাজাতে অংশ নেন।
ইজতেমাগামী সাধারণ মুসল্লি যারা তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে রওয়ানা হয়েছিলেন কিন্তু মোনাজাত শুরুর পর তারা সেখান থেকেই মোনাজাতে অংশ নেন। হাঁটতে হাঁটতেই দুইহাত তুলে ইজতেমায় যেতে থাকেন।
অপরদিকে, এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মহিউদ্দিন মাহমুদ ও নাজিমুদ্দিন খান লিয়ন জানান, বিমান বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে।
মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসল্লিদের ঢল নেমেছে। দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লি এখানে দল বেঁধে এসেছেন। লাখো মানুষের ঢলে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউ প্রাইভেটকারে, কেউ কেউ ট্রাকে করে বিশ্ব ইজতেমা মাঠে এখনো উপস্থিত হচ্ছেন।
র্যাডিসন এলাকায় বাস চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
মহিউদ্দিন মাহমুদ ও নাজিমুদ্দিন খান লিয়ন আরো জানান, রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলের সামনে থেকে ইজতেমাগামী বড় বাসগুলোকে টঙ্গী যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। এখান থেকে ইজতেমাগামী মুসল্লিদের পায়ে হেঁটে ইজতেমার দিকে যেতে দেখা যায়। তবে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, অটোরিকশাসহ ছোট ছোট পিকআপ ভ্যানে করে শত শত মুসল্লি ইজতেমা মাঠে রওয়ানা হন।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, নিরাপত্তা ও যানজট এড়াতে বড় বাসকে ইজতেমা মাঠে যেতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে, বনানীর কাকলি রেলস্টেশনের পাশে ছাত্রলীগ মুসল্লিদের জন্য পানি পানের ব্যবস্থা করেছে।
গত শুক্রবার (০৯ জানুয়ারি ২০১৫) বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা মো. এহসানের আম বয়ানের মাধ্যমে ইজতেমা শুরু হয়। বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. আব্দুল মতিন।
এর আগে বৃহস্পতিবার আসরের পর থেকেই ভারতের মাওলানা আহম্মদ লাট ময়দানে আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে ঈমান, আমল ও আখলাকের প্রাক বয়ান শুরু করেন।
এরই মধ্যে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে ইজতেমার মাঠ। টঙ্গী এখন পরিণত হয়েছে ধর্মীয় উৎসবের নগরীতে।
ইজতেমা ময়দানে শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হন। এতে অংশ নেন লাখো মুসল্লি।
ইজতেমা মাঠে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইজতেমায় বিদেশি ও সাধারণ মুসল্লিদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ, আনসার ও র্যাব সদস্যসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন।
এর চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ১৮ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে ওই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে।
এ বছর মাঠে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থানের জন্য পুরো ময়দানকে প্রথম দফায় ৪০টি এবং দ্বিতীয় দফায় ৩৯টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। জেলাওয়ারি জামাতবদ্ধ মুসল্লিরা এসব নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান করছেন।
বিশ্ব ইজতেমার জন্য তুরাগ নদের তীরে ১৬০ একর জমির ওপর মুসল্লিদের জন্য টানানো হয়েছে বাঁশ আর চটের তৈরি প্যান্ডেল। প্রতিদিন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শত শত মুসল্লির অংশগ্রহণে সুবিশাল প্যান্ডেল তৈরি হয়।
সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা বরাবরের মতো মুসল্লিদের পারাপারের সুবিধার্থে তুরাগ নদের ওপর ৭টি ভাসমান বেইলি ব্রিজ তৈরি করেছেন।
৯ জানুয়ারি ফজরের নামাজের পর থেকে আম বয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়।
ইজতেমা ময়দান প্রথম পর্বের ইস্তেমায় দেশের ৩৪ জেলা থেকে মুসল্লিরা এসেছেন। সে জন্য ৩৪টি খিত্তা স্থাপন করা হয়েছে। আর বিদেশি ও প্রবাসী মুসল্লিদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে পৃথক প্যান্ডেল। সেখান কেন্দ্রীয়ভাবে রান্না করা খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ইজতেমার মুসল্লিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে টঙ্গী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে জানিয়েছিলেন, মুসুল্লিদের নিরাপত্তার জন্য পোশাকে ও সাদা পোশাকে, পুলিশ, গোয়েন্দা এবং র্যাব সদস্যদের সমন্বয়ে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে স্থাপন করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ারও।
ইজতেমার মাঠের প্রস্তুতির কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা তাবলীগের গিয়াস উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের বাইরে থেকে গত বছর প্রায় প্রায় ১৭ হাজার বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছিলেন। এবার তা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তিনি জানান, বিদেশি মুসল্লিদের জন্য ইজতেমা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে টিন-চট দিয়ে বিশেষ কামরা তৈরি করা হয়েছে। বিদেশি মুসল্লিদের জন্য তুরাগ নদের তীরে রান্নার চুলা ও রন্ধনশালা নির্মাণ করা হয়েছে।
তিতাস গ্যাসের টঙ্গী অঞ্চলের ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল আহাদ বাংলানিউজকে জানান, তাদের চারজন প্রকৌশলীসহ ১৩ জনের দল ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের রন্ধনশালায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুজিবুর রহমান কাজল জানান, ১১টি উৎপাদন নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন তিন কোটি লিটারেরও বেশি নিরাপদ পানি নিশ্চিত ও সরবরাহের সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ওজু-গোসলের হাউজ ও টয়লেটসহ প্রয়োজনীয় স্থানে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
এছাড়াও বহুতল পাকা দালানে চার হাজারের বেশি টয়লেট ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত অজু গোসলখানা এবং টয়লেটগুলো ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া মশক নিধনে ২০টি ফগার মেশিন কাজ করছে।
ডেসকোর সূত্র জানায়, ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি রয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিডকে মূল ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হবে, যাতে যে কোনো একটি গ্রিড অকেজো হলেও সামগ্রিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত না হয়।
ইজতেমা এলাকায় ৪টি জেনারেটর এবং ৫টি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমার তৈরি রাখা হয়েছে। এছাড়া ৫টি অস্থায়ী বিদ্যুৎ ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। এতে প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ বলেন, ইজতেমার নিরাপত্তায় পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ থাকছে। টহল পুলিশও কাজ করছে। এর পাশাপাশি ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। র্যাবের পাশাপাশি পুলিশেরও স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করছে।
সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য একটি সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমের অধীনে পাঁচটি সাব-কন্ট্রোল রুম কাজ করছে। দুর্ঘটনা ও ভিআইপি বহনের জন্য ৩টি হলিপ্যাড থাকবে।
ইজতেমার নিরাপত্তায় ১০ হাজারের মতো পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান তিনি।
মিডিয়া সেন্টারে ফ্রি ওয়াইফাই
পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশিদ জানান, সংবাদ সংগ্রহে আসা সংবাদকর্মীদের জন্য একটি মিডিয়া সেন্টার ও সেখানে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের (ফ্রি ওয়াইফাই জোন) ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান লিটন জানান, ইজতেমাস্থলে তাদের একটি কন্ট্রোল রুমও স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা দায়িত্ব পালন করছেন।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, তাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিকেল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে মন্নু গেট, অ্যাটলাস গেট, বাটা কারখানার গেট ও টঙ্গী হাসপাতাল মাঠসহ ৬টি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন রয়েছে। আশপাশের খাবারের দোকানে ও ইজতেমাস্থল এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিআরটিসির পরিচালক কর্নেল মো. আব্দুল্লাহিল করিম জানান, মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন স্টেশন থেকে ৩০০টি বাস চলাচল করবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিদেশি মেহমানদের যাতায়াতের জন্য ৬টি এসি বাসও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫
** মোনাজাত শেষে রাস্তায় মুসল্লিদের ঢল
** আখেরি মোনাজাতে অংশ নিলেন খালেদা
** তুরাগ তীরে দুহাত তুলেছেন লাখো মুসল্লি
** তুরাগ তীরে মুসল্লিদের ঢল
** সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত
** বিশ্ব ইজতেমায় আরো ৪ মুসল্লির মৃত্যু
** নিরাপত্তার চাদরে ইজতেমা ময়দান: ডিআইজি
** বিশ্বে ইজতেমায় যৌতুক বিহীন ১২০ বিয়ে
** বিশ্ব ইজতেমায় আরো ৪ মুসল্লির মৃত্যু