ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার পোড়াবাড়ি বাজার এলাকার তরুণ মাছ চাষী আবু নোমান। প্রায় এক যুগ ধরে ৩০ একর জমিতে মাছ চাষ করছেন ।
এখন বিক্রি করলে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়তে হবে। ফলে বিক্রয় উপযোগী এমন মাছের জন্য খরচ হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। জেলে বিনিয়োগ আটকে থাকার পাশাপাশি বাড়তি খরচের দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত পড়েছে এ তরুণ চাষীর।
দুর্দশার এ চিত্র শুধু নোমানের একার নয়, তার মতো রূপালি বিপ্লবে দিনবদলের স্বপ্ন দেখা আরো শত শত মাছ চাষী লাগাতার অবরোধে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। স্থানীয় বাজার ছাড়া কোথাও পরিবহনের সুযোগ না থাকায় চাষকৃত মাছের দাম পাচ্ছেন না তারা। দিন কাটাচ্ছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
৯০ দশকের গোড়া থেকে ময়মনসিংহে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মাছ চাষ। ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের দু’পাশে (ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলার পয়েন্ট) ঘটে গেছে নীরব মৎস্য বিপ্লব। দুদিকে যত চোখ যায়, শুধু বিশালাকৃতির পুকুর আর পুকুর।
এসব পুকুরে বছর জুড়ে চাষ করা হয় পাঙ্গাস, কৈ সহ বিভিন্ন প্রজাতির বাংলা মাছ (তেলাপিয়া, রুই, মৃগেল)। এর মাধ্যমে হাজার হাজার যুবক বেকারত্ব ঘুচানোর পাশাপাশি অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা বিভিন্ন হ্যাচারি থেকেও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ কেজি রেণু পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। জাতীয়ভাবে উৎপাদিত মাছের ১৬ ভাগ উৎপাদিত হয় এ জেলা থেকে। কিন্তু টানা অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের মৎস্য খাত। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দেশের কোথাও যাচ্ছে না মাছ।
স্থানীয় সূত্র বাংলা জানায়, অবরোধের আগেও ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকা থেকেও ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২’শ থেকে আড়াইশ টন মাছ যেতো ট্রাক-পিকআপে। ঢাকার মাছের চাহিদার অন্তত ৭০ ভাগ পূরণ করতো ময়মনসিংহের চাষীরা। কোনো জেলা থেকেই ব্যাপারীরা না আসায় এক সপ্তাহ ধরে কোনো মাছ বাজারজাত করতে পারছেন না খামারীরা।
ত্রিশাল উপজেলার কাকচর গ্রামের মাছ চাষী আপেল মাহমুদ (৩০) বাংলানিউজকে জানান, ৬ একর জমিতে ১০ বছর ধরে তিনি মাছ চাষ করছেন। তার খামারে বিক্রির উপযোগী পাঙ্গাস রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার পিস। অবরোধের কারণে যেমন মাছ বিক্রি করতে পারছেন না তেমনি উত্তরবঙ্গ থেকে মাছের খাবারও আনতে পারছেন না।
তিনি জানান, এক কেজি পাঙ্গাস উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় ৯০ টাকা। অবরোধ থাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়মিত আসা ব্যাপারীরা এখানে ভিড়তে পারছেন না। আগুন দেওয়ার ভয়ে তাদের ট্রাক-পিকআপও পাঠাচ্ছেন না। ফলে স্থানীয় পাইকারদের কাছে ১০ টাকা লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে মাছ।
ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কে নিয়মিত চলাচলকারী (ঢাকা মেট্রো-ঢ-১৪৪৭১২) মাছবাহী ট্রাকের চালক মুজিবুর রহমান (৩৮) জানান, ‘সাধারণত রাতে ট্রাকে মাছ লোড করা হয়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয়ে সাহস করে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আমাদের পেটেও টান লেগেছে।
স্থানীয় খামারীরা জানান, প্রতিদিন ট্রাক-পিকআপে উত্তরবঙ্গের জেলা নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মাছের খাবার ভুট্টা, রাইস পালশি, খৈল ত্রিশালে আসে। সাধারণত ট্রাক ভাড়া বাবদ খরচ পড়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু অবরোধের কারণে ট্রাক ভাড়া চাচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার টাকা !
তারা জানান, ফিশারিতে থাকা মাছ বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার মাছের খাবার পরিবহনের দামও প্রায় ৩ গুণ গিয়ে ঠেকেছে। ফলে মূলধন হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন এখানকার চাষীরা।
যোগাযোগ করা হলে ময়মনসিংহ জেলা হ্যাচারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল বাতেন বাংলানিউজকে বলেন, শুধুমাত্র ত্রিশালের ধলা থেকেই প্রতি সপ্তাহে অর্ধ কোটি টাকার রেণু পোনা বিক্রি হয়। কিন্তু অবরোধে ব্যবসা লাটে উঠেছে। লোকসানের মুখে রয়েছেন হ্যাচারী ব্যবসায়ীরা।
একই সঙ্গে বাণ্যিজিক মৎস্য খামারের চাষীরাও প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছেন। শুধুমাত্র চলমান রাজনৈতিক অস্থরিতায় এ মৎস্য খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদশে সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫