ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলানিউজকে পররাষ্ট্রসচিব

বাংলাদেশ এখন মিরাকল মডেল

মাহমুদ মেনন ও জেসমিন পাপড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫
বাংলাদেশ এখন মিরাকল মডেল পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক / ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে ভালো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এতটা ভালো সম্পর্ক আর কখনোই ছিলো না।

রাশিয়া-জাপান-চীনের সঙ্গে কূটনীতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি দারুণ সময় পার করেছে, নতুন নতুন বন্ধু রাষ্ট্র হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গেও সরকারের রয়েছে অসাধারণ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক।

বাংলানিউজকে দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক।

একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে বিশ্ব কূটনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক। কথা হয় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকার নিয়েও।

পররাষ্ট্রসচিব বাংলানিউজকে জানান, বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপ্রাপ্ত ভোকাল। প্রায় সকল আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশ তার মতামত দিচ্ছে এবং তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিতও হচ্ছে। আর বিশ্ব শান্তির পক্ষে ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে বাংলাদেশ নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে। যেখানেই শান্তির আলোচনা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান সেখানে ‘বাই ডিফল্ট’ উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম, বলেন শহীদুল হক।

তিনি জানান, বিশ্ব নেতৃত্ব এখন ২০১৫ উত্তর উন্নয়ন এজেন্ডা তৈরির কাজ করছে। আর এই এজেন্ডায় বাংলাদেশ তার প্রধান অগ্রাধিকার জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র নিরসন ও অভিবাসন-উন্নয়ন এ তিনটি ইস্যুকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে অন্তর্ভূক্ত করাতে পেরেছে।

এর আগেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা-এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে তা এখন গোটা বিশ্বে ‘মিরাকল মডেল’ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে বিষ্ময়, অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা একটি দেশ এতগুলো বিষয়ে এত স্বল্প সময়ে কিভাবে উন্নয়ন নিশ্চিত করলো, জানান শহীদুল হক।

উত্তরটিও জানা রয়েছে এই সফল কূটনীতিক ও আমলার কাছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ের যে প্রচেষ্টা রয়েছে তা-ই এই অগ্রগতির প্রধান চাবিকাঠি।

শহীদুল হক বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে জাতীয় উন্নয়নের এমন সম্পৃক্ততা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। প্রতিটি মানুষ কাজ করছে, তার নিজের উন্নয়নের চেষ্টায় রয়েছে আর তার মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন। প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে একটা কিছু করার উদ্যম।

তিনি বলেন, এই যে ঢাকার রাস্তায় কোটি মানুষের আনাগোনা, এই যে বিশাল ট্রাফিক জ্যাম, এটাই উন্নয়নের ইন্ডিকেটর, অর্থনীতি সচল থাকার উদাহরণ আর মানুষ যে বসে নেই, বেরিয়ে পড়েছে তাদের কাজ নিয়ে, সাফ্যল্যের উদ্দেশ্য নিয়ে তারই প্রকাশ।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গত ছয় বছরে অনেক ‘ইমেজ বিল্ডিং’ হয়েছে উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, এখন আর দারিদ্রপীড়িত, ক্ষুধাক্রান্ত, অশিক্ষিত, স্বাস্থহীনতার দেশ নয় বাংলাদেশ। বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে অনেক এগিয়ে থাকা একটি দেশ। কেবল তা-ই নয়, বিশ্বের প্রয়োজনে বাংলাদেশ যে অবদান রাখছে তাও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।

তিনি বলেন, শান্তি ও উন্নয়নের ‘নর্ম সেটিং’, শান্তিরক্ষা ও সন্ত্রাসবিরোধীতায় বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে। ‘শান্তির সংস্কৃতি’ নামে বিশ্বব্যাপী যে ক্যাম্পেইন তারও প্রবক্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ মনে করে শান্তির পথেই উন্নয়ন। যেখানেই সহিংসতা তার বিরুদ্ধেই বাংলাদেশ। আর বিশ্ব নেতারাও জানেন এ ক্ষেত্রে তাদের যে কোনও উদ্যোগেই বাংলাদেশ পাশে থাকবে।

আর পাশাপাশি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ বহুপাক্ষিক গণতন্ত্রের দেশ হিসেবেই পরিচিত।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা গতবছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগ ছিলো এমন প্রশ্নে শহীদুল হক বলেন, বিশ্বের কোনও দেশই আরেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খুব একটা নাক গলায় না। বাংলাদেশ যেমন অন্য দেশের প্রসঙ্গে কোনও কথা বলে না, অন্যদেশও বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবে না, এটাই কূটনীতিক আচরণ। কিন্তু এটা সত্য এ ধরনের কথা খুব প্রচারিত হয়, মিডিয়া হাইফ তৈরি করা হয়, আর এ জন্য আন্তর্জাতিক কিছু পেইড সংস্থা রয়েছে তারাই দায়ী। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা লুটতে কোনও কোনও রাজনৈতিক পক্ষ অর্থ খরচ করে এ ধরনের কাজগুলো করানোর প্রয়াশ পায়। তবে এগুলো বড় ইস্যু হিসেবে দেখে না বিশ্বের কোনও গণতান্ত্রিক দেশই। বাংলাদেশও এগুলোতে গুরুত্ব দেয় না, বলেন শহীদুল হক।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন করেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই চেতনা বিশ্বের কাছেও সমাদৃত। সেই মনোভাব থেকেই তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনও দেশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনও কথা কখনোই বলবে না এটাই স্বাভাবিক। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে সরকার যখন ব্যবস্থা নেয় তখন বিশ্বের কোনও দেশেরই তার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ নেই।

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে, বাংলানিউজের পক্ষ থেকে এমন প্রসঙ্গ টানলেই উপরোক্ত কথাগুলো বলেন শহীদুল হক।

তিনি বলেন, আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, বিশ্বের কোনও রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থা নয়, কিছু কিছু ব্যক্তি বা সংস্থা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তার বিনিময়েই এসব মানবাধিকারের ধুয়া তোলে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনও ভার্সন নয়।

সরকার বিরোধী ক্যাম্পেইন করে আন্তর্জাতিকভাবে সুবিধা নেওয়া সম্ভব হবে!, এমন দিন এখন চলে গেছে, বলেন শহীদুল হক। যারা এই কাজগুলো করে যাচ্ছে তারা বৃথাই তাদের অর্থ ও শ্রম ব্যয় করছে।

কথা হয় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দিক নিয়েও। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এখন বিশ্বের কাছে ‘অভিবাসন উন্নয়ন’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা সময় ছিলো অভিবাসন যে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে সেকথাই মানা হতো না। এখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার সুযোগ এসেছে। উন্নয়ন এজেন্ডাতেই যুক্ত হচ্ছে অভিবাসন ইস্যু।

শহীদুল হক বাংলাদেশের কোটি মানুষ বিদেশে পাড়ি দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতেও তাদের শ্রম ও মেধা ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের উন্নয়নে। বাংলাদেশ স্পষ্টভাবেই মনে করে এটি উন্নয়নের একটি বড় দিক। আর সে কারণেই সকল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে বাংলাদেশ অভিবাসন ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসছে।

২০১৬ সালে মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গ্লোবাল ফোরামে বাংলাদেশ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে, জানান শহীদুল হক।  

আর জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ভোকাল হিসেবেই বিশ্বে এখন প্রতিষ্ঠিত। যেখানেই জলবায়ু ইস্যুতে আলোচনা সেখানেই বাংলাদেশ কথা বলছে, বলেন তিনি। ২০১৪ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আহ্বান জানান, ২০১৫ সালেও প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনে উপস্থিত থেকে, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে তার অবস্থান তুলে ধরবেন।

উন্নত বিশ্বের কাছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে তাদের যে ভূমিকা ও তার মোকাবেলা তাদের যা করণীয় তা বার বারই উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে, বলেন তিনি।

বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি বন্ধু দেশ হিসেবে গৃহীত, বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবেই সমাদৃত বলে মন্তব্য করেন এই কূটনীতিক ও আমলা।

তিনি বলেন, নতুন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে হয় সফর করে, নয়তো আন্তর্জাতিক ফোরামে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়ে কথা বলেছেন, সেখানে সবখানেই আমরা দেখেছি নেতাদের আন্তরিকতা, তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও তার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয়।

কূটনীতিতে বডি ল্যাঙ্গুয়েজটি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা এই ভঙ্গিমা থেকেই বুঝে নেই কে কি বলতে চান, বলেন শহীদুল হক।

বাংলানিউজের অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ব বা পশ্চিম নয়, বরং পূর্ব-পশ্চিম, নিকট ও দূর প্রতিবেশি সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্ক এখন চমৎকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, সেই প্রথম ও প্রধান নীতিতেই চলেছে বাংলাদেশের কূটনীতি।

বাংলাদেশ সময় ১০৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।