ঢাকা: অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (নিটার) । তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পদত্যাগের দাবি তুলে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে প্রতিষ্ঠান ছাড়া করেছে অধ্যক্ষ ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ুন কবীরকে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ,এই সুযোগেই সেখানে অনিয়ম আর লুটপাটের স্বর্গ রচনায় কোমর বেধে মাঠে নেমেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে অস্থিতিশীল করার নেপথ্যের কুশীলবরা।
যাদের লক্ষ্য প্রভাব আর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নিজের আখের গোছানো আর প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছাঁনো- বাংলানিউজের সাথে আলাপকালে এমনটাই বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী।
রাজধানীর অদূরে সাভারের নয়ারহাটে অবস্থিত জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (নিটার) বস্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন ৪শ’২০ জন শিক্ষার্থী।
২০১২ সালের ১১ মার্চ ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ুন কবীর অধ্যক্ষ পদে যোগদানের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা ও শিক্ষার প্রসারে এগিয়ে যেতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে এর আর্থিক কাঠামো মজবুত করতে গিয়েই বাধে বিপত্তি।
ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে কল্পিত নানা ব্যয় দেখিয়ে তহবিল নিঃস্ব করার নেপথ্যে থাকা দুর্নীতিবাজদের মাথায় হাত পড়ে। সপ্তাহে কিংবা মাসের নির্দিষ্ট দিনে এসে উপস্থিতি বা রেজিস্ট্রার খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে বেতন ভাতা উত্তোলনকারীদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে বন্ধ হয়ে যায় অফিস কামাই করে ফাঁকিবাজি।
বিটিএম, বিটিএমসি এবং নিট্রার্ড প্রজেক্ট তিনটি ধারায় বিভক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনেকেই এ সময় এক হয়ে নামেন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ জানুয়ারি পদত্যাগের দাবি তুলে অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে ক্যাম্পাসে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান,অধ্যক্ষ ড.ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ুন কবীর ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা পরিদর্শনে যান।
পরে তিনি গত ৩১শে ডিসেম্বরে ক্যাম্পাসে সংঘটিত তুচ্ছ একটি ঘটনার ব্যাপারে কথা বলার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের তার কক্ষে আসতে বলার পর থেকেই শুরু হয় তাণ্ডব।
এরপরই বাইরে শুরু হয় প্রচণ্ড হৈচৈ। অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিতে প্লাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে মিছিলের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ভাঙচুর ও তাণ্ডব চালিয়ে সৃষ্টি করা হয় নারকীয় পরিস্থিতির।
অধ্যক্ষের কার্যালয়ে কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, এই নারকীয় ঘটনা কত বীভৎস ছিলো তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।
হামলাকারীরা অধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। তার কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আগের মেয়াদে অধ্যক্ষের কক্ষে ভাঙচুর ও তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি করে তছনছ করা হয় গোটা কক্ষ।
কক্ষে থাকা কম্পিউটার, গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, মার্কশিট, সার্টিফিকেট, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ছাত্রদের অপকর্ম ও অপরাধের মূল নথিপত্র ছাড়াও কেড়ে নেয়া হয় অধ্যক্ষের মুঠোফোন ও ড্রয়ারে থাকা বেশ কিছু টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় অভিযোগ করা হলেও হামলাকারীরা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের কাছে কেউ সাক্ষী দিলে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল বাংলানিউজকে জানান,আমি দায়িত্বগ্রহণের দিনই শিক্ষার্থীরা তাণ্ডব চালিয়ে প্রতিষ্ঠান অধ্যক্ষকে সাভার ছাড়া করেছে। শিক্ষার্থীদের উস্কে দেবার নেপথ্যে কতিপয় শিক্ষকদের অর্থায়ন ও ভূমিকার কথাও প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তিনি জানান,সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর,লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলেও জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে জানান,বর্তমান অধ্যক্ষ নিটারে যোগদান করার আগে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি ছিল মাত্র ৮০ জনের। তার প্রচেষ্টাতেই পরবর্তীতে তা ১৮০ জনে উন্নীত হয়।
ওই শিক্ষার্থীর আশংকা নিজের পরিচয় প্রকাশ পেলেই ক্যাম্পাসে তাণ্ডব সৃষ্টিকারী শিক্ষার্থীরা তাকেও ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী বাংলানিউজকে জানান,মূলত স্বার্থ আর প্রভাবের দ্বন্দ্বের কারণেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষকে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে শিক্ষকদের একটি অংশ। এর সামনের কাতারে রয়েছে এটিএম ফয়েজ স্যার। তার পরিকল্পনা আর ছকেই সে দিনের তাণ্ডব পরিচালিত হয় – যোগ করেন ওই শিক্ষার্থী।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এটিএম ফয়েজ বাংলানিউজকে জানান,‘প্রতিষ্ঠানটির বৈধ অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সাথে অধ্যক্ষের ঝামেলা।
তিনি আরও জানান,‘তাণ্ডবের নেপথ্যের কুশীলব হিসেবে আমার অর্থায়ন করার কিংবা উস্কানি দেবার অভিযোগ কাল্পনিক। কোন শিক্ষার্থীই আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনতে পারবে না’ দৃঢতার সাথে যোগ করেন এই শিক্ষক।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ,প্রশাসন ও হিসাব বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি নিরুপণ,জড়িতদের অপসারণ,সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৈনিক উপস্থিতির উপর কড়া নজরদারি,শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ক্যান্টিন নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে প্রদান না করা,প্রথম এ্যাসেসমেন্ট পরীক্ষায় কতিপয় অসৎ শিক্ষক ও কর্মচারী ছাড়াও অনুত্তীর্ণদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়া,শিক্ষার্থীদের অনিয়ম ও বিলম্বে জরিমানা আদায়,নকল রশিদ এবং ব্যাংকের ভূয়া সিল প্রদান করে ফি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা,হোস্টেলের কিছু বিপথগামী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ,ছাত্রদের সংঘর্ষে শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হবার ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ,ক্লাস পরীক্ষা তদারকি,পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপই অধ্যক্ষের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে জানান,আমি আমার সন্তানের মতো প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেছিলাম। চেয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বমানের পর্যায়ে নিতে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজও শুরু করেছিলাম।
তিনি জানান,আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখে আমার কক্ষে যে নারকীয় হামলা চালানো হয়েছে তা মনে হতেই গা শিউরে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে আমার চাকরি করা সম্ভব নয়।
নিয়োগপত্রের লিখিত শর্তমতে দু’মাস হাতে রেখেই আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা গভর্নিং বডিকে জানিয়েছি। ’
তিনি বলেন,‘যারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে ফায়দা হাসিল করতে চাইছেন একদিন তারাই এর ফল ভোগ করবেন। পরিকল্পিত এ ঘটনায় আমি অপমানিত। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে আমি যে সম্মান হারিয়েছি তা ছিল আমার জীবনে অর্জিত মূল্যবান সম্পদ। এরপরও আমি নিটারকে ভালোবাসি এবং নিটারের জন্য শুভকামনা করি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫