ঢাকা: কুয়াশা কেটে কটকটে রোদ মাথার ওপর। তবে শীতের এই মিষ্টি রোদ গায়ে মাখার মতো পরিস্থতি নেই আমানউল্লাহ’র।
কেবল আমান উল্লাহ একাই নয় তার মতো হাজতে থাকা পাঁচ নারীর ‘স্বামীদের’ জন্যে সোমবার দিনটি যেন অশুভ। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই। কারণ নানা অজুহাত আর ছুতোয় ঘরের বাইরে যাওয়া গৃহিনীরা ঘরে না ফিরে তখন থানার হাজতে। এদের কেউ ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে মর্নিং ওয়াকের কথা বলে,কেউ বা বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দেবার কথা বলে,কেউ বা আবার সাত সকালে আত্নীয়ের বাড়ি যাবার কথা বলে বেরিয়েছিলেন বাসা থেকে। তারপর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েই আটকা পড়েন পুলিশের জালে।
যে যাই বলেই ঘর থেকে বের হন না কেন সবার গন্তব্যই শেষতক যখন থানার হাজতে তখন স্বামী বেচারাদের হৃদয়ে মান অভিমান আর ক্ষোভ ভর করা যে অস্বাভাবিক নয় সেই ভয় আর আশংকাতেই এসব নারীদের অনেকে মুখ লুকোচ্ছিলেন থানার হাজতেই।
কেউ লজ্জায় কেউ বা হয়রানির ভয়ে চেপে যাচ্ছিলেন রাজনৈতিক পরিচয়। যেমন পৌরসভার ভাটপাড়ার মতিউর রহমানের স্ত্রী নাজনীন আক্তার বাংলানিউজকে বলেন,আমার ব্রেস্ট ক্যান্সার। ঢাকায় রোগ নির্ণয়ের জন্যে যাবার পথে রাস্তা থেকে আমাকে পুলিশ বিনা কারণে ধরে এনেছে। পৌরসভার দিলখুশাবাগ মহল্লার মতিয়ুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা রহমান আইরিন রাজনৈতিক পরিচয় এড়িয়ে গিয়ে বাংলানিউজকে জানান, আমাকে কখনো মিছিল মিটিং এ দেখেছেন! আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। সকালে বিউটি পার্লারে যাবার পথে গন্ডগোলের মধ্যে পড়ি। সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে ধরে এনেছে।
বনপুকুরের আমান উল্লাহর স্ত্রী পারভীন আমান বাংলানিউজকে জানান,হাটঁতে বেড়িয়েছিলাম,পুলিশ আমাদের ধরে আনলো। তবে অলিগলি ছেড়ে ঢাকা আরিচা মহাসড়কে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি তিনি।
একই সুর বিনোদবাইদ মহল্লার বাসিন্দা আসাদুজ্জামানের স্ত্রী আসমা আক্তারের কণ্ঠে। বাংলানিউজকে তিনি জানান,বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার যাবার পথেই পুলিশ আমাদের ধরে এনেছে। কেবল বনপুকুরের তুহিনুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন ইসলাম বাকরুদ্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ও থানার হাজতে অবস্থানে নিজেও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ। মনে হচ্ছিলো দুঃস্বপ্নের ঘোরেই রয়েছেন তিনি।
হাজতে যখন এই অবস্থা তখন বাইরে উৎকণ্ঠায় থাকা স্বামীদের চোখে মুখে অসহায়ত্ব। এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির ছাতা ধরে বেশ কয়েকজন পেশাদার তদ্বিরবাজকে পাঠালেন থানায়।
অপারেশন অফিসার সোহেব আলী বাংলানিউজের সামনেই তাদের বলেন, নো কম্প্রোমাইজ। এরা ভিভিআইপিদের আত্নীয় হলেও করার কিছু নেই। সিনিয়র স্যাররা ধরেছেন। থানা থেকে তো ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।
থানায় ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে থাকা সহকারী উপপরিদর্শক(এএসআই) শিউলী খাতুন বাংলানিউজকে জানান,সচারচর থানায় নারী হাজতি থাকে না বললেই চলে। তবে আবাসিক হোটেলে অভিযান চালালে মহিলা হাজতখানা কিছুটা প্রাণ পায়। আজও তেমনি প্রাণ পেয়েছে। তবে কারণটা ভিন্ন। তিনি জানান,গাড়ি ভাঙচুরের সময় হাতে নাতে আটক হলেও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে মুখ খুলছেন না কেউই।
তিনি বললেন, ‘অন্যান্য দিন খাবার নিয়ে থানায় সামনে জড়ো হন আটকে থাকা স্বামীদের স্ত্রীরা। আজ ব্যতিক্রম। আজ সোয়ামীরাই উৎকণ্ঠিত হয়ে ভিড় জমিয়েছেন থানার সামনে। ’
এই নারী পুলিশ কর্মকর্তার কথার মিল খুঁজে পাওয়া গেলো থানার অভ্যন্তরেই।
হাজতি আসমা আক্তারের জন্যে স্বামী আসাদুজ্জামান সকালের নাস্তা নিয়ে হাজত খানার সেন্ট্রির সাথে অনুনয় বিনয় করছিলেন। ‘একটিবার মাত্র ওকে দেখে চলে যাবো,দুটি কথা জানতে চাইবো।
‘এই কি তোমার স্কুলে যাওয়া !‘ কথা গুলো মাটিতে পড়ার আগেই পুলিশ সেন্ট্রি ঠেলে ধাক্কায় থানার গেইটের আছে নিয়ে যান আসাদুজ্জামানকে।
সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোতাবেল মিয়া বাংলানিউজকে জানান,গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় আটককৃত নারীদের চালান করা হবে।
‘আমরা জানতাম ভোর থেকেই এসব নারী মাঠে নামবেন তাই পাঁচটা থেকেই নারী পুলিশ নিয়ে আমরাও তৈরি ছিলাম’ যোগ করেন মোতালেব মিয়া।
ভাটপাড়ার মতিউর রহমান বেশ বিব্রত। রাজনীতির সাতে পাঁচে নেই। স্ত্রী আটক হয়েছেন- শরমে নিকটজনদের খবরটিও দিতে পারছেন না তিনি।
মতিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান,কতবার ওকে বুঝিয়েছি রাজনীতি আমাদের জন্যে না। যেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়বা সেদিন কিন্তু রক্ষা করার মতো নেতাদের কাউকে কাছে পাবে না। আজ সেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি- আক্ষেপের সাথে যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান,রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুরুষ কর্মীরা কাপুরুষ হয়ে আজ নারীদের সামনে ঠেলে দিয়েছেন। তার মাশুল গুণতে হচ্ছে আমাকে।
বনপুকুরের তুহিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান,‘জানেনই তো বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে কত! দেখবেন পুরনো পেন্ডিং মামলাতে এদের চালান করবে। জামিন হলেও দেখা যাবে জেল গেইট থেকে আটক করবে। আমার সংসার সামলাবে কে। বাচ্চাদের স্কুলেই বা নেবে কে! যেখানে বেগম খালেদা জিয়ার এই দশা সেখানে আমার স্ত্রীর ভাগ্যে ভালো আর কি আশা করতে পারি। ’ বেশ ক্ষোভের সাথেই এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেন তিনি।
দিলখুশাবাগের মতিয়ুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ‘আমার বৌ বেশ সৌখিন। নিজেই বিউটি পার্লার পরিচালনা করে। আমি জানতাম সে বিএনপির সমর্থক। কিন্তু এভাবে মিছিল ভাঙচুরে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ’
‘এই শীতের মধ্যে আমার বউ হাজতে থাকবে ক্যামনে আমরাই বা ওকে ছাড়া কীভাবে চলবো এসব ভাবতেই মাথায় জট পেকে যাচ্ছে। ’
স্ত্রীর প্রতি চাপা অভিমান আর দেশের চলমান রাজনীতিকে প্রকাশ্যেই শাপ শাপান্ত করছিলেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বাংলানিউজকে জানান,পিকেটিং ও গাড়ি ভাঙচুর করার সময় পুলিশ তাদের হাতে নাতে গ্রেপ্তার করেছে। আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এর নেপথ্যে আর কারা জড়িত তাদের নাম ঠিকানা জানান চেষ্টা করছি।
তিনি জানান, ‘এ সব নারীদের রাখার মতো পরিবেশ থানার হাজতে নেই। তাই দ্রুত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব শেষ করে তাদের আদালতে চালান করার চিন্তা ভাবনা চলছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪