ঢাকা: বছরের শুরুতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা লাগাতার অবরোধে রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই বিচ্ছিন্নভাবে আগুনে পুড়ছে বাস-ট্রাক-পিকআপ-সিএনজি অটোরিকশা। সঙ্গে পুড়ছে বাসের ড্রাইভার ও হেলপারদের ভাগ্য।
মঙ্গলবার (১৩ জানুয়ারি) রাজধানীতে চলাচলকারী লোকাল বাসগুলোর বেশ কয়েকজন ড্রাইভার ও হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের প্রথমদিকে ও দুই ঈদে বাস থেকে ভালো আয় হওয়ার আশা করেন তারা। কিন্তু এবার বেকার হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের।
নুর ইসলাম (৪৫)। বাড়ি রায়েরবাগ। রাজধানীতে চলাচলকারী ৬ নম্বর বাসে হেলপারের কাজ করতেন। গত বুধবার (৭ জানুয়ারি) গুলিস্তান মোড়ে চলন্ত অবস্থায় তাদের গাড়িতে আগুন দিয়ে পালায় অবরোধকারীরা।
তিনি বলেন, কয়দিন থাইকাই বইসা রইছি। আমার দুই মাইয়া। এই মাসে হেগো স্কুলের ট্যাকা দেওন লাগবো। আর এশোম (সময়) গাড়ি পুইড়া গেলো। হেগো বেতনতো দূরের কতা, পরিবারের খাওন জুটতাছে না।
সরকারি এক অফিসের স্টাফবাসের ড্রাইভার মো. আলী (৪৯)। তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। তার অবস্থা আরো করুণ। টাকার অভাবে গত কয়েক দিন ধরে বাড়িতেই যান না তিনি।
এ অবস্থার জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ী করে তিনি বলেন, যারা রাজনীতি করে তাগো গাড়ি পোড়ায় না। আমরা কী করছি? খালি বড়লোকের বেলা ষোল আনা আর আমগো বেলায় কিছুই না। আইজ কয়দিন থাইক্যা গ্যারেজেই পইরা রইছি। কবে গাড়ি ঠিক হইবো! হেইদিনকা গাড়ি চালাইয়া ট্যাকা নিয়া বাড়িত যাইতে পারুম!
বিহঙ্গ বাসের হেলপার মো. রুবেলের (২৫) বাড়ি চাঁদপুর। রাজধানীর বেড়িবাঁধ এলাকায় থাকেন। তিনি যে গাড়িতে কাজ করতেন সেটি ৪ জানুয়ারি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, প্রতিমাসেই মার অষুধ আর বোইনের পড়ার ট্যাকা দেওন লাগে। এবার কোনোডাই দেবার পারি নাইক্যা।
অন্য কোনো কাজ করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, করন যায়। তয় মালিকের গাড়ি পুইড়া গেছে, আমগো থাইক্যা হের আরও বেশি ক্ষতি হইছে।
তারে বিপদে ফালাইয়া কি যাওন যায়? আমরা চাই আমগো জন্য না দিলেও, সরকার মালিকের লাইগ্যা যেন কিছু দেয়।
তানজিল পরিবহনের একটি বাসের ড্রাইভার রশিদ মিয়া (৩৬) বিবরণ দিলেন আগুন দেওয়ার সময় তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, পুলিশ আমগো গাড়ির সামনেই ছিলো। মোড় ঘুরতাছি। এর মধ্যে পেছন থাইক্যা আগুন ধাই-ধাই কইরা আমার সামনে আইসা পড়লো। তখন জীবন বাঁচাইমু, নাকি গাড়ি বাঁচামু! লাফ দিয়া দৌড় দিলাম।
তিনি বললেন, গাড়িতো পরের কথা আমগো জীবনইতো বাঁচে না। আর এখন বেকার পইড়া রইছি। খাওনেরও ঠিক নাই। দেশের এ অবস্থা বন্ধ হওয়া দরকার।
মো. ইউসুফ (২৭) তানজিল পরিবহনের একটি বাসে হেলপারের কাজ করতেন। গাড়িতে আগুন দেওয়ার পর থেকে বেকার হয়ে বসে আছেন। ভাগ্যের এ পরিণতি যেন মেনেই নিয়েছেন।
তিনি বলেন, প্রতিদিন কামাই হইতো ৩০০ থাইক্যা ৫০০ টাকা। হেইডা দিয়াইতো পরিবার চলতো না। আর এহনতো কামাই না। কি আর করা। আমগোতো আর কেউ নাই। তাই মাইনা লইছি।
এদের মতো রফিক, শাহাদত, আলীমসহ আরো অনেকেরই একই অবস্থা। রাজনৈতিক সহিংসতায় এমন ভাগ্য বরণ করে নেওয়ার পর তাদের সঙ্গে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তাদের কারও ছেলে-মেয়ে, কারও মা, কারও বা বোন।
মেরামতের পর যে গাড়িটা আবারও পোড়ানো হতে পারে- এই আশংকাও তাদের অনেকের রয়েছে। এই অস্থির পরিস্থিতি, ভীতিকর পরিবেশ, আতঙ্ক, ভোগান্তি- এসব থেকে কবে রেহাই পাবে দেশের মানুষ- এমন প্রশ্ন এখন কর্মমুখী সব মানুষেরই।
বাংলাদেশ সময় : ১২২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৫