ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঘৃণা এইডসকে, রোগীকে নয়

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৫
ঘৃণা এইডসকে, রোগীকে নয় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কিশোরী মালা (ছদ্মনাম) বাল্য বিয়ের শিকার। প্রবাসী বর পেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা।

কিন্তু সন্তান না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে তাকে অপমানিত হতে হচ্ছিলো প্রতিদিন। এক পর্যায়ে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলেন তিনি, কিন্তু জানতেন না কী ভয়ংকর ভবিষ্যৎ তার সামনে।
 
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানতে পারলেন, স্বামীর এইডস (এইচআইভি-HIV নামক ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ব্যাধি) হয়েছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক মালাকেও পরীক্ষা করলেন এক সময়। ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা মালা ও গর্ভের সন্তানেরও এইচআইভি পজিটিভ বলে জানা গেলো।
 
এক সময় মালার স্বামী মারা যান। পরিবার-গ্রামের মানুষ কেউ এলো না কবর দিতে। তাদের ধারণা- মাটিতে রোগটি ছড়াবে, সেখানে যে গাছ হবে, তাতে যে ফল হবে, তা খেলে মানুষের এইডস হবে। মরদেহটি আগুনে পোড়াতে দিতেও চাইলো না কেউ। তাদের আরও ধারণা- ধোঁয়ার সঙ্গে রোগ ছড়াবে।
 
স্বামীর মরদেহকে গোসল করানো, কবর দেওয়া- নিজের হাতেই করলেন অসুস্থ মালা।
 
মালাকে পুরোই অস্পৃশ্য-অভুক্ত রাখলো স্বজনরা। এক সময় সন্তান মারা যায়। মালা আশ্রয়ের আশায় আসেন বাবার বাড়ি। গর্ভধারিণী মাও তাকে চিনতে চাইলেন না, খেতে দিলেন না। পাঁচ দিনের অভুক্ত মালা একটি সংস্থায় ফোন দিতে পারলেন কোনোভাবে। এখন তিনি সংস্থাটির আশ্রয়ে, কিন্তু প্রশ্ন তার একটাই- ‘আমার অপরাধ কোথায়? কেন এমন জীবন?
 
প্রায় একইরকম গল্প সব এইডস রোগীর। এভাবেই সমাজে পুরোপুরি অস্পৃশ্য করে রাখা হয় তাদের, যার মূল কারণ রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব।
 
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসব জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
 
মঙ্গলবার (০১ ডিসেম্বর) ‘বিশ্ব এইডস দিবস-২০১৫’ পালিত হয়েছে বাংলাদেশেও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এদিন সকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে শোভাযাত্রা, এরপর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভা, প্রদর্শনী ও নাটকের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে।  

এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ধরা হয়, ‘এইচআইভি সংক্রামণ ও এইডস মৃত্যু নয় একটিও আর, বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়বো সবাই এই আমাদের অঙ্গীকার’।
 
বক্তারা বলছেন, এইডস রোগীকে ঘৃণা নয়, বরং রোগটিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এইচআইভি পজেটিভ মানুষগুলো সমাজে যে বৈষম্যের শিকার হন, তার কারণ রোগটি সম্পর্কে মানুষের অসচেতনতা। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে, নিয়ে আসতে হবে মূলধারায়।
 
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, রোগটিতে আক্রান্তদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তারা সমাজে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। রোগটি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, ভুল ধারণা থেকে এ সমস্যাটি হচ্ছে।
 
আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
 
তিনি সরকারি হিসেব জানিয়ে বলেন, ২০১৫ সালে (নভেম্বর ২০১৪-অক্টোবর-২০১৫) পর্যন্ত এ রোগে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৪শ’ ৬৯ জন, মারা গেছেন ৯৫ জন। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে রোগটিতে আক্রান্ত চিহ্নিত হন। সেই বছর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ১শ’ ৪৩, মারা গেছেন ৬শ’ ৫৮।
 
মন্ত্রী বলেন, দেশে রোগটিতে আক্রান্তের হার এক শতাংশেরও কম। আমাদের এখন থেকে সচেতন হতে হবে। সংবাদমাধ্যম ও পরিবার-অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে। আক্রান্তদের অবহেলা হয়, সহযোগিতা দিতে হবে।
 
৭টি মেডিকেল কলেজ, ১২টি হাসপাতাল ও ৩টি এনজিও বিনামূল্যে এইডসের সেবা দিচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী। সরকারের পাশাপাশি এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ, বিত্তবানদের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তিনি।
 
এদেশে সব ধর্মের মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে বলে রোগটিতে আক্রান্তের হার কম বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আগামী মার্চে বাংলাদেশে আই-ক্যাপ আয়োজন হবে বলেও জানান তিনি।  
 
স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মন্জুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক, এনএএসপি পরিচালক ডা. মো. শফিকুল আলম, এসটিআই/এইডস নেটওয়ার্ক চেয়ারপারসন আবু ইউসুফ চৌধুরী, ইউএনএইডস’র কান্ট্রি ডিরেক্টর লিও কেনী, নেটওয়ার্কস অব পিএলএইচআইভি সভাপতি হাবীবা আখতার প্রমুখ।
 
দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে এইডস রোগীদের মধ্যে ইঞ্জেকশন থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। অভিবাসী, ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী, মাদকসেবী ও সমকামীরা এইডস ঝুঁকিতে রয়েছেন।
 
হাবীবা আক্তার বক্তব্যের শুরুতেই উপরের কাহিনীটির ভিডিও দেখালেন। যেখানে অসহায় মালা কথা শেষ করতে পারে না, কান্নায় ভেঙে পড়ে।
 
হাবীবা বলেন, আক্রান্তদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। জুনে এ সংক্রান্ত সরকারি প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগেই নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
 
এ রোগের চিকিৎসায় বিদেশি অর্থের সঙ্গে সরকারি তহবিল আরও বাড়ানোর কথাও জানান হাবীবা।
 
আবু ইউসুফ বলেন, পাঠ্য বইতে এ বিষয়ে পড়তে পারছে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এটি চালু রাখতে হবে। নিয়মিত ফলোআপ রাখতে হবে।
 
শফিকুল আলম বলেন, সিরিঞ্জের মাধ্যমে যারা নেশা করছে, তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার বাড়ছে।
 
লিও কেনী বলেন, অতীতের তুলনায় রোগটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে- এটি ঠিক। তবু বাংলাদেশে সংখ্যাটি এখনও অনেক কম। তাই সময় থাকতে কাজ বাড়াতে হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ২২১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৫
এসকেএস/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।