ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির এক বছর

বার বার নৌযান ডুবিতে হুমকিতে সুন্দরবন

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
বার বার নৌযান ডুবিতে হুমকিতে সুন্দরবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

খুলনা: পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকায় তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির এক বছর পরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। সুন্দরবনের অভ্যন্তরের স্পর্শকাতর চ্যানেল দিয়ে এখনও কার্গো বা জাহাজ চলাচল করছে।

ঘন কুয়াশার মধ্যে চলাচলরত এসব নৌযানের অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। এসব নৌযান ধারণ ক্ষমতার অধিক তেল ও মালামাল নিয়ে চলাচল করছে। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি বড় নৌ দ‍ুর্ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবনে।

২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাংকার সাউদার্ন স্টার সেভেন ডুবে সাড়ে ৩ লাখ লিটার জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র সুন্দরবন অববাহিকায়। সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীর অন্তত ৫০০ কি.মি. এলাকা জুড়ে বিষাক্ত এই তেলের বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে। বনবিভাগ প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করলেও ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সময় সাময়িকভাবে সুন্দরবনের নৌপথ দিয়ে সকল প্রকার নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলেও কিছুদিন পর ফের নৌ চলাচল চালু হয়।

এর মাত্র ৫ মাস পরেই আবারো ২০১৫ সালের ৫ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর বিমলের চরে এমভি জাবালে নূর নামে একটি সারবাহী কার্গো ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ৫শ’ মেট্রিক টন এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ছিলো বলে জানিয়েছিলো বন বিভাগ।

২৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাত ৮টার দিকে সুন্দরবনের বিউটি মার্কেট এলাকার খাদ্য গুদামের সামনে পশুর নদীতে এমভি জিআর রাজ নামে একটি জাহাজ ডুবে যায়। মংলা বন্দরের হাড়বাড়িয়া-১ থেকে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে যশোরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল জলযানটি।

১ ডিসেম্বর রাতে ঘন কুয়াশায় পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরাভোলা চরে ৭৪০ মেট্রিকটন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ফ্লাইঅ্যাশ) নিয়ে এমভি শোভন-১ নামে আরও একটি জাহাজ দ‍ুর্ঘটনায় পতিত হয়।

সর্বশেষ ০৩ ডিসেম্বর দুপুরে বন্দরের পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়ার ৫নং বয়ায় থাকা বিদেশি জাহাজ এমভি ইয়ানচুন পণ্য খালাস শেষে বন্দর ত্যাগ করে। এসময় আল হেলাল-১ নামে একটি নৌযানে করে ওই জাহাজ থেকে গ্রাফ নিয়ে মংলায় আসার পথে দুপুরে নৌযানটি তলা ফেটে মূল চ্যানেলে ডুবে যায়।

এছাড়াও ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলে হাড়বাড়িয়া এলাকায় প্রায় ৬০৩০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি হাজেরা-২ নামে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়।

পরে আবারো ৩০ সেপ্টেম্বর ৬শ’ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে আরো একটি কার্গো জাহাজ পশুর চ্যানেলে জয়মনি গোল এলাকায় ডুবে যায়। একই বছরের ২৪ নভেম্বর একটি যাত্রীবাহী তিনতলা লঞ্চ এমভি শাহীদুত সুন্দরবনের হরিণটানা এলাকায় ডুবে যায়। ওই ঘটনায় বন বিভাগ ৫০ কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে।

এর আগে সুন্দরবনে ১৯৮৮ সালে দু’বার এবং ১৯৯৪ সালে সুন্দরবনে তেল দূষণের ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণে ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনে তেল দূষণে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে এবং এর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনের আশঙ্কাকে আমলে নেয়নি কেউ।

এরপর ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নৌরুটটি বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু কেউ কারো কথা আমলে নেয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, এসব দুর্ঘটনার পর ধীর গতিতে দায়সারা উদ্ধার তৎপরতা চালায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর কারণে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ফ্লাই অ্যাশ) ও সার সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালের পানিতে মিশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে সেখানকার জলজ, বনজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। বিশেষ করে ফার্নেস অয়েলে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে নির্ধারিত স্থানে ডলফিনের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। ফার্নেস অয়েলের কালো স্তর থেকে রক্ষা পায়নি বিখ্যাত সুন্দরী গাছের শ্বাসমূল, ভেসে আসা বীজ এমনকি স্থানীয় গৃহস্থের হাঁস-মুরগি পর্যন্ত।

কেউ কেউ বলছেন, ট্যাংকার ও জাহাজডুবির ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা করে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। কোনো শাস্তি বা কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি পক্ষ চক্রান্ত করে সুন্দরবন ও মংলা বন্দরকে ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে এসব ফিটনেসবিহীন নৌযান ডুবাচ্ছে। সেই সাথে হাতিয়ে নিচ্ছে বীমার টাকা ও ফাঁকি দিচ্ছে ব্যাংকের লোন। বন ও বন্দর ধ্বংসকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়ার দাবি জানান তারা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ড. আনোয়ারুল কাদির মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) বাংলানিউজকে বলেন, গত এক বছরে সুন্দরবনে ৪টি বড় নৌযান ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বনের গহীনে ছোট-বড় আরো অসংখ্যা দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়নি।

তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের অদূরদর্শিতা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা আর মালিকপক্ষের অবহেলার কারণে বারবার সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীতে লাইটার ও ট্যাংকার ডুবির ঘটনা ঘটছে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটার পরও অদৃশ্য কারণে টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। নানা কারণে সুন্দরবনের সুরক্ষায় বর্তমান বন প্রশাসন অক্ষম।

তিনি জানান, পশ্চিম বাংলার সুন্দরবন রক্ষায় রাজ্য সরকারের পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে। আমাদের সুন্দরবন অনেক বেশি সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ বন নিয়ে সরকারের ভাবনা কম। সরকারের উচিত বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুন্দরবন বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর গঠন করা। আর এটি করতে হবে সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য।

আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবনের বুকচিরে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো জাহাজ অবাধে চলাচল, মাঝে মধ্যে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল নদীতে সয়লাবসহ নানাবিধ কৃত্রিম সংকটে হুমকির মুখে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন যেন কাঁদছে!

তিনি বলেন, ৬ মাসের মধ্যে মংলা ঘষিয়াখালি নৌ চ্যানেল কাটার কথা থাকলেও তা এখনও সম্পন্ন হয়নি। ফলে বনের মধ্য দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে নৌযান চলাচল করছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরবন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও অ্যাগ্রো টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. সরদার শরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি দ‍ুর্ঘটনা থেকেই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। সুন্দরবনকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য অবিলম্বে স্থায়ীভাবে বনের মধ্যে নৌযান চলাচল বন্ধের দাবি জানান তিনি।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনোস্কসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মর্যাদা বুঝলেও আমাদের সম্পদের মর্যাদা আমরা বুঝিনি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের মনোভাবের কারণে আজ সুন্দরবন তার স্বকীয়তা ও সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, অযোগ্য চালক ও ফিটনেস বিহীন ট্যাংকার জাহাজ বনের মধ্যে চলাচলের কারণে দ‍ুর্ঘটনা ঘটছে। নৌযান রাতে বনের মধ্যে চলাচল করছে। যা সম্পূর্ণ বে-আইনি। এ বিষয়ে বনবিভাগ বর্তমানে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

গত এক বছরে কতটি দুর্ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫টি। এর মধ্যে তিনটিতে মামলা হয়েছে, যা চলমান রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০২৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।