ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির একবছর

সুন্দরবনে বন্ধ হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ নৌ চলাচল

সরদার ইনজামামুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
সুন্দরবনে বন্ধ হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ নৌ চলাচল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

বাগেরহাট: ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির এক বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের এই দিনে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় ফার্নেস তেলবাহী ট্যাঙ্কার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’।

এতে সাড়ে ৩ লাখ টন ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খালে।  
 
দুর্ঘটনার পর হুমকির মুখে পড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বনের ভেতর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধে পরামর্শ দেয় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। তবে, দুর্ঘটনার এক বছরেও এ পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়নি। বরং ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
 
তেল বিপর্যয়ের এ ঘটনায় সারা বিশ্বে উদ্বেগের সৃষ্টি হয় সুন্দরবনকে নিয়ে। আসে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গবেষক দল। দুর্ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে জাতিসংঘ সে সময় ২৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়। ২৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনে অবস্থান করে বনের শ্যালা ও পশুর নদের তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকা পরিদর্শন ও বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে তারা।
 
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ওই প্রতিনিধি দল ফিরে যাওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সুন্দরবনের পরিবেশকে মহামূল্যবান ও বৈচিত্র্যপূর্ণ উল্লেখ করে বনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধের সুপারিশ করে’। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।  
 
ট্যাঙ্কার ডুবির পর চলতি বছরের অন্তত দু'টি বড় নৌ দুর্ঘটনা ঘটে সুন্দরবনে। ৫ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর চরে তলা ফেটে ডুবে যায় সারবাহী জাহাজ এমভি জাবালে নূর।   ২৭ অক্টোবর চাঁদপাই রেঞ্জের পশুর নদীর জয়মনি সংলগ্ন বিউটি মার্কেট এলাকায় ডুবে যায় কয়লাবাহী একটি কার্গো জাহাজ। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পার হলেও এখনো উদ্ধার হয়নি এমভি জিয়ার রাজ নামের এ কার্গো জাহাজটি।
 
সর্বশেষ ০১ ডিসেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর চরে আটকা পড়ে ৭৪০ মেট্রিকটন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ফ্লাইঅ্যাশ বোঝাই এমভি শোভন-১ নামে একটি কার্গো। অবশ্য বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগেই জাহাজটি উদ্ধার করা হয়।
 
বারবার দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের ক্ষতি সত্ত্বেও বনের ভেতর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা।
 
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, বারবার দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। কিন্তু আমাদের সরকার এ দিকে এখনও উদাসীন। রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে বনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ কয়লা পরিবহন হবে। তখন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও বাড়বে।
  
ডিসেম্বরে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর সরেজমিনে সুন্দরবনে আসা গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দীন খান বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন বিশ্ব সম্পদ। তাই কেবল বাংলাদেশ নয় সুন্দরবনের ক্ষতিতে সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন হয়। তা আমরা ট্যাঙ্কার ডুবির পর দেখেছি। সরকারসহ আমাদের সবার উচিত বিশেষজ্ঞসহ পরিবেশবিদদের মতামতের ভিত্তিতে সুন্দরবন সুরক্ষায় এক সঙ্গে কাজ করা।
 
তিনি বলেন, বনজ সম্পদ শিকার বা পাচার যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, একইভাবে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলও এই বনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। জাহাজের বর্জ্য প্রতিনিয়ত আমাদের এই মহামূল্যবান বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করছে।
 
তিনি আরও বলেন, উন্নয়নের নামে বনের চারপাশে মহামারির মতো যেভাবে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে তা হুমকিতে ফেলছে সুন্দরবনকে। তাই এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে যে ক্ষতি হবে তা আর পূরণ করা যাবে না।
 
ট্যাঙ্কার ডুবির পর বিশ্বে বিপন্ন প্রায় ইরাবতি ডলফিনের অভয়াশ্রম শ্যালা নদী দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে নৌযান চলাচল বন্ধ হবে বলে সরকারি ঘোষণা দেওয়া হলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও পুরোপুরি চালু করা যায়নি বিকল্প নৌরুট মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল।
 
বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) এ এইচ ফরহাদুজ্জামান বলেন, মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ-চ্যানেল খনন কাজ চলমান রয়েছে। চ্যানেলের দুই তীরের ছোট ছোট খালগুলো এখন প্রবাহমান না থাকায় প্রতিনিয়ত প্রচুর পলি জমছে। তাই খনন কাজ অব্যহত রয়েছে। বর্তমানে এ নৌপথে পূর্ণ জোয়ারে ১০-১১ ফুট গভীরতার নৌযান চলাচল করছে।
 
এদিকে, শীতের সময় কুয়াশার কারণে নৌ দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকায় রাতে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশনা নিয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ।
 
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাতে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করতে না দেওয়ার নির্দেশনা পেয়েছি। আমার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। সবকটি স্টেশনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
 
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়া উচিৎ। কিন্তু চাইলেও এ মুহূর্তে জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা হিসেবে আমরা রাতে নৌযান চালাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।
 
রাতে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি দিনে বনের ভেতর যেসব নৌযান প্রবেশ করবে তার ফিটনেস ও দক্ষ চালক আছে কিনা -বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য বিআইডব্লিউটিএর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ডিএফও।    

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৫     
এমজেড

** বার বার নৌযান ডুবিতে হুমকিতে সুন্দরবন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।