মোস্তফা নগর থেকে ফিরে: 'ছেলে যুদ্ধে যাওয়ার আগে বলেছিল, মা যুদ্ধে যাচ্ছি, সবাই ফিরে এলেও আমি যুদ্ধ শেষ না করে ফিরে আসবো না। কিন্তু ছেলে আর ফিরে এলো না, দেশের জন্য রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল।
কান্না জড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলোই বলছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালে মা মালেকা বেগম (৭৫)।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক মোস্তফা কামাল। দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে একজন। এক এক করে ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে, আজও ছেলের স্মৃতিচারণ করে কাঁদেন তিনি। ৭১ সালে এমন দিনে ছেলে যুদ্ধে ছিল, তাই বিজয়ের মাস এলেই বেশি বেশি মনে পড়ে ছেলের কথা।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিল মোস্তফা, সে ছিল খুব সাহসী। চারজন মিলে যে কাজটি করতে না পারতো সেটি একাই করতে পারতো মোস্তফা। খেলাধুলায় ওর সঙ্গে কেউ পেরে উঠতে পারতো না, সাঁতারে ছিল বেশ পারদর্শী। শক্তিশালী থাকায় কুস্তিতে খুব ভালো ছিল সে।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের স্ত্রী পেয়ারা বেগম মারা গেছেন। ছেলে মোশারেফ হোসেন বাচ্চুও বেঁচে নেই। বাচ্চুর স্ত্রী পারভীন আক্তার মুক্তি বেঁচে আছেন। একমাত্র মেয়ে কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।
মোস্তফা কামাল তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। বর্তমানে ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নের মোস্তফা নগরের (মৌটুপি) ওই বাড়িতে মোস্তফা কামালের ছোট ভাই মুস্তাফিজুর রহমান ও তার ছেলে সেলিমসহ পরিবারের সদস্যরা থাকেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বাড়িতে গেলে তার মা মালেকা বেগম ছেলের ছবি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মালেকা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ছেলের নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলো, কিন্তু কলেজটি এখনও জাতীয়করণ হয়নি। সরকারি চাকরি হয়নি পরিবারের কারও। তাই জীবিত থাকতে অন্তত আরেকটু সাহায্য-সহযোগিতা চাই।
মোস্তফা কামালের ভাইয়ের ছেলে সেলিম বাংলানিউজকে জানান, ছেলের স্মৃতি মনে করেই বিভিন্ন সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন দাদু (মালেকা বেগম)। তিনি এতটাই শোকাহত যে আমরাও তার ছেলের স্মৃতি মনে করে দিই না কিংবা জানতে চাইনা। ছেলের কথা মনে পড়লেই তার কান্না কিছুতেই থামানো যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তিনি। এ জন্য আমরা দেশের মানুষের কাছে খুবই সম্মানিত।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হলেও বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবস ছাড়া আমাদের খবর কেউ নেয় না। এ দিনে গণমাধ্যমকর্মীরা বাসায় এসে খোঁজখবর নেন।
মালেকা বেগমের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দাদু বলেছেন, আমার এক ছেলে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন করেছে আমার আরেক ছেলেকে দেশের সেবা করার জন্য বলেছি। তাই আমরা মোস্তফা কামালের নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি, অসহায় মানুষের সেবা এবং বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করার চিন্তা-ভাবনা করছেন তিনি।
দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে হাবিলদার হাবিবুর রহমানের ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পুরো প্লাটুন পিছু হটে। প্লাটুনের নয় জন যোদ্ধা শহীদ হন। কিন্তু মোস্তফা কামাল পিছু না হটে এলএমজি দিয়ে গুলি চালিয়ে বহু শত্রুসেনাকে ঘায়েল করেন। একপর্যায়ে শত্রুর গুলিতে শহীদ হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত এ ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের গ্রামের বাড়ি মেঘনায় বিলীন হয়ে গেলে ১৯৮২ সালে সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপি গ্রামে কিছু স্মৃতিসহ তার পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। গ্রামের নাম রাখা হয় শহীদ স্মরণিকা। বর্তমানে ওই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠের নামে মোস্তফা নগর করা হয়েছে। এছাড়াও ওই গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের নামে একটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণ করে সরকার। তবে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা, দক্ষ জনবলের অভাবসহ নানা কারণে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। এসব সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
এমজেড