ঢাকা: জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সম্মান জানাতে ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত করা হয়েছে মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর এই স্মৃতিসৌধের রক্তে রাঙা লাল বেদিতে ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কাপুরুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে নীলনকশা তৈরি করে। এর অংশ হিসেবে তদের এ দেশিয় দোসর নরঘাতক রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের দিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের ওপর চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু ১৫ ডিসেম্বর রাতের বিজয়ের উষালগ্ন পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালায় কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনী। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর নির্মম নির্যাতন-নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে শহীদ হন বুদ্ধিজীবীরা।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যা স্মরণে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পরের বছর ১৯৭২ সাল থেকেই সশ্রদ্ধ চিত্তে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন। এ স্মৃতিসৌধের নকশা তৈরি করেন স্থপতি মোস্তফা হারুন কুদ্দুস।
শনিবার (১২ ডিসেম্বর) সরেজমিনে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুরোদমে চলছে রঙ আর ধোয়া-মোছার কাজ। রাতের মধ্যে সব কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরতরা।
২২ লাখ টাকা ব্যয়ে গত ১৪ নভেম্বর থেকে ‘বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ’ এর অংশ হিসেবে এ কাজ শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে ঠিকদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাইশা ট্রেডিং।
কাজের অগ্রগতি পর্ববেক্ষণে আসা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ব্যবস্থাপক ফারুক হাসান মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, কাজ শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। রঙ করা থেকে ধোয়া-মোছা সব কাজই রাতের ভেতরে শেষ হয়ে যাবে।
মাইশা ট্রেডিংয়ের পক্ষে কাজের সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বন্ধু ও সহযোগী শান্তি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত একমাস ধরে আমি প্রতিদিন স্মৃতিসৌধে আসছি। কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যে কাজ বাকি আছে তা রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, প্রধান গেট দিয়ে ঢোকার পথে একদল পরিচ্ছন্নকর্মী মূল স্তম্ভে যাওয়ার রাস্তাটি ধোয়া-মোছায় ব্যস্ত। আর একদল স্মৃতিসৌধের ভেতরে থাকা গাছগুলোর গোড়া রঙ করছেন পরম যত্নে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে স্মৃতিসৌধের ভেতরের খালি স্থানগুলোও।
আর যে স্থানটিতে ফুল দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, সে স্থানটির ইটগুলো রক্তের মতো লাল রঙ ধারণ করে আছে। এ যেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তেরই প্রতিচ্ছবি। সেই রক্তের ওপর ফুল দিয়েই শ্রদ্ধা জানানো হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
স্মৃতিসৌধটির দক্ষিণ দিকে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া দুই বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান ও সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধি। সেখানে আছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রয়াত দেশের বুদ্ধিজীবীদের সমাধিস্থলও।
স্মৃতিসৌধের ভেতরের একটি নামফলক থেকে জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৫ সালের ৮ জুলাই স্মৃতিসৌধে বৃক্ষরোপন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সে সময় তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ছিলেন। যে স্থানটিতে এ নামফলক আছে তার পাশেই অবস্থিত বুদ্ধিজীবীদের গণকবর।
১৯৭১ সালে নরঘাতক রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের সহায়তায় কাপুরুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতোজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে তার প্রকৃত তথ্য স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও পাওয়া যায়নি।
তবে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে সে অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বৃদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
তাদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. জি সি দেব, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতন চন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ জাতির আরও অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এএসএস/এএসআর