ময়মনসিংহ: প্রতি শুক্রবার ময়মনসিংহের জয়নুল উদ্যান পার্ক, সার্কিট হাউজ ও গণহত্যা ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান তিনি। হাতে বোর্ড, স্ট্যান্ড ও কলম।
চার দশক আগে একাত্তরে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস ও লড়াইয়ের মাধ্যমেই জাতি পেয়েছে স্বাধীনতা। এবার তিনি বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে নিজের জবানিতে তুলে ধরতে চান যুদ্ধদিনের সেইসব বীরগাঁথা। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের তিনি শোনাতে চান জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন, বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। তাদের মনে বপন করতে চান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রের বীজ। উদ্বুদ্ধ করতে চান অবিনাশী এ চেতনায়। নিজের এমন স্বপ্নের কথাই জানালেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
এমন মহতী স্বপ্ন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের সহায়তা চান বিমল পাল। আর এর মাধ্যমেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ না দেখা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চান।
শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের এমন স্বপ্নের কথা তুলে ধরলেন এ বীর। নিজের স্বপ্নের বাইরেও রণাঙ্গনের গল্প, জীবনযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে আলাপে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিমল পাল স্বতঃস্ফূর্ত তাড়নায় ছুটে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের তুরায় গেরিলা ক্যাম্পে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার উত্তর-পশ্চিম দিকে পাহাড়ি আঁচলে ঢাকা সবুজ ধানক্ষেত আর শেওয়াল নদীবিধৌত আদিবাসী গ্রাম তেলিখালী। সেই তেলিখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অনেক অভিজ্ঞতা। অনেক সহযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে দেখেছেন।
একাত্তরের ১৪ জুলাই ঢালু সাবসেক্টরে পোস্টিং হয় বিমলের। তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন হালুয়াঘাটের আলী হোসেন। ১৭ জুলাই নাগলা ব্রিজ, তন্দর, নুন্নী ও সর্বশেষ ৩ নভেম্বর তেলিখালী যুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
তেলিখালী যুদ্ধে হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলির ফাঁকে নিজেদের উজ্জীবিত করতে আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতাম, বলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। এ যুদ্ধে নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার সঙ্গে থাকা ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২১ জন মিত্রবাহিনীর সদস্য শহীদ হন।
একাত্তরে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী এ বীর যোদ্ধা পরাজিত জীবনযুদ্ধে। ময়মনসিংহ শহরের থানার ঘাট এলাকায় একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। আয়-রোজগার সামান্যই। কিন্তু এ নিয়ে ন্যূনতম আক্ষেপ নেই। বললেন, আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। আমার জীবনমান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। চা-পান বিক্রি করে সংসার চালাই। মাসে ১০ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতা পাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধা পল্লীতে সরকার ঘর দিয়েছে। আমি সুখেই আছি।
জীবনের শেষ বেলায় এসে তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে কাজ শুরু করেছেন বিমল পাল। স্বপ্রণোদিত হয়ে স্থানীয় বলাশপুরের মুক্তিযোদ্ধা পল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান তিনি। নগরীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুকুল নিকেতনেও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের রণাঙ্গনের গল্প শোনান।
প্রতি শুক্রবার ময়মনসিংহের জয়নুল উদ্যান পার্ক, সার্কিট হাউজ ও গণহত্যা ফলকের সামনে বিমল পালের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনলে বুঝতে পারি, কতো ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। এসব গল্প শুনে দেশের প্রতি ভালোবাসা আরও বহুগুনে বেড়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব বীরত্বগাঁথা আমাদের চিরদিন মনে থাকবে।
ময়মনসিংহ জেলার সবগুলো সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাকে একটি ক্লাস নিতে দেওয়ার দাবি রণাঙ্গন কাঁপানো এ বীর সেনানির। যেখানে তিনি তুলে ধরতে চান ময়মনসিংহের মাঠপর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
বিমল পাল বলেন, চক-ডাস্টারের সাহায্যে ব্ল্যাকবোর্ডে আমি মুক্তিযুদ্ধ আঁকি। ময়মনসিংহের কোন দিক দিয়ে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই বিষয়টিই নতুন প্রজন্মকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিতে চাই। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বীজ বপণ করতে চাই। ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুর যুদ্ধ, খাগডহর যুদ্ধ, দীঘারকান্দা যুদ্ধ, বোরোরচর ফাইট, ঈশ্বরগঞ্জ যুদ্ধ, বাউলিয়াবাজার যুদ্ধ, তেলিখালী যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলাম আমি। এ ৭টি যুদ্ধই আমার মনে রেকর্ড করা আছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিলিয়ে বেড়ানো বিমল পাল মনে করেন, তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ অক্ষরবন্দি হওয়া সময়ের দাবি। নিজেও লিখতে চান ‘মুক্তিযুদ্ধ : ময়মনসিংহ’ নামে একটি বই।
পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস ও মূল্যবোধে উৎসাহিত করতে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
আরএম