ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শত বছরের পথে বোস কেবিনের চায়ের আড্ডা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৬
শত বছরের পথে বোস কেবিনের চায়ের আড্ডা ছবি: দীপু মালাকার

নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে: রাজধানীর পাশের জেলা শহর। শীতলক্ষ্যার পাড়ের এই নারায়ণগঞ্জ শহরের বন্দরে আসতো কত শত নেতাকর্মী।

স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা এই শহরে এলে চা খেতে আসতেন সনাতন পাল লেনে।

নারায়ণগঞ্জের ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামে রাজনৈতিক দলের সভা শেষ হয়েছে শনিবার (২৯ অক্টোবর) সূর্য নেভার একটু আগেই। পৌরসভার মাঠে মঞ্চের ওপরে নিচে যে নেতাদের দেখা গিয়েছিল তাদের একটি অংশ সেখান থেকে সোজা বোসের কেবিনে। রেললাইনের পাশ ধরে এই রেস্তোরাঁর সামনের স্থানটুকু গমগম করছে আড্ডায়। বিকেলের জনসভার চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। শামীম ওসমান আর আইভী রহমানের রাজনৈতিক দূরত্ব এখানে চায়ের কাপে আরও বেশি গরম হয়ে উঠছে।

বোসের কেবিনের ভেতরে জায়গা খুব বেশি নেই। প্রথম কেবিনের পর আরেকটি কেবিন। প্রথম কেবিনে সবমিলিয়ে ২৪ জনের বসার স্থান। দ্বিতীয় কেবিনেও তাই। অনেকেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন। সিট খালি হওয়ার অপেক্ষায়। তবে এখানে এমনি ক্রেতা কম আসেন। নিয়মিত আর একটি শ্রেণির নারায়ণগঞ্জবাসীই এই বোস কেবিনের ভোক্তা।

৮৯ বছরের বেশি বয়স হাবিবুর রহমানের। মঞ্চে জমিদার দর্পণ থেকে শুরু করে হ্যামলেটের মতো নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। শহরের এই নাট্যকর্মী তার জীবনের গত ৬৫ বছর ধরেই আসছেন এই বোসের কেবিনে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এখানে সবাই আসে, প্রতিদিন একবার আসি। এই জায়গাটা পরিচিত, পরিবর্তন হয়নি, ভালো লাগে।

হাবিবুর রহমান জানান, দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, ঊনশত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ সকল ইতিহাসের সাক্ষী এই বোসের কেবিন। ৯৫ বছর বয়স চলছে এই খাবারের দোকানের।

তিনি বলেন, নৃপেন চন্দ্র বোস বিক্রমপুর থেকে এই অঞ্চলে আসেন। সবাই তাকে ভুলুবাবু নামেই জানতেন। তখন এটা ছিল শুধুই চা আর বিস্কুটের ছোট দোকান। কাঁচ্চা বিস্কুট বলা হতো। ১৯২১ সালে এই জায়গাতেই তিনি দোকান দেন। নিউ বোস কেবিনের আগে এই দোকানকে অনেকে ভুলুর দোকান বলেও চিনতেন। ভুলুবাবুর পর তার ছেলে, তারপর তার নাতি এখন দোকান চালাচ্ছেন।

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে লিকারের চা খাইয়ে তৃপ্ত করেছিলেন ভুলুবাবু। তখন থেকেই তার চায়ের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

একই টেবিলে চা খাচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, নাট্যকর্মী বাহারউদ্দিন বুলু। সবারই নিয়মিত আড্ডা এখানে। জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছাড়াও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সামসুজ্জোহা, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের মতো পণ্ডিতেরা এখানে এসে চা পান করেছেন। এখানে চলতো স্বদেশী আন্দোলনের আড্ডা।

বোস কেবিনের ইতিহাসের মতোই এখানে গত ৫০ বছর ধরে কর্মরত গুপিনাথ সাহা। ২০ বছর বয়স থেকেই এখানে রয়েছেন তিনি। চা পরিবেশনের সময় হাতের কাঁপুনিতে কাপ উপচে পিরিচে পড়ে চা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এখানকার ভোক্তারাও তাই।

গুপিনাথ বলেন, যখন এখানে আসি, তখন চপের দাম ছিল ৪ আনা, চায়ের দাম এক আনা থেকে দুই আনা। এখন একটা চপের দাম ১৫ টাকা, চায়ের কাপ ১০ টাকা। আশপাশের পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এই চায়ের দাম বেড়েছে, স্বাদ কিন্তু আগের মতোই!
নিজের ৫ মেয়ে, এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এখানে কাজ করেই। শুধু পয়সার জন্যে নয়, ভালোবাসা থেকেই এখানে রয়েছেন তিনি।

ম্যানেজার সুজিত সাহা বাংলানিউজকে বলেন, এখন ভুলুবাবুর নাতি তারাক বোস এই দোকানের দেখাশুনা করেন। এখানে সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি চলে চা। দুপুরে বা রাতে ভাতের কোনো ব্যবস্থা নেই। সকালের নাস্তায় রয়েছে, দুধ চা আর রং চা। চা পার্শেল করে নিতে হলে কাপ প্রতি ১৫ টাকা করে দিতে হয়। পরোটা, হালুয়া, ডাল, ভাজি, মুরগি কারি ও খাসি কারির সঙ্গে রয়েছে স্পেশাল ডিম অমলেট। এই বিশেষ ডিম অমলেট বোস কেবিন ছাড়া দেশের আর কোথাও হয় না বলেও জানান তিনি।

বিকেলের নাস্তাতে স্পেশাল পরোটার সঙ্গে ডিম চপ আর খাসির মাংসের কাটলেট যুক্ত হয়। এই দুটোরই বেশ চাহিদা এখানে।

সৌম্যনাথ বণিক গত ৭ বছর ধরে এখানে চায়ের কারিগরের সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, এখানে চা প্রধান। চা তৈরির স্পেশাল কিছু নেই। এটা হাতের বিষয়। পানি জ্বাল দেয়া, লিকার করা এসব এমনি এমনি একটা হিসেবে হয়ে যায়।

বোস কেবিনে বসার স্থানের চেয়ে ভেতরের রান্না ঘর, গুদাম ঘর অনেক বড় এবং বেশ পরিচ্ছন্ন।

সুজিত বলেন, বোস কেবিনে এখন ২০ জন কর্মচারী রয়েছে। ২০১৪ সালে উপজেলা অফিসের সহযোগিতায় এখানকার টাইলসগুলো পরিবর্তন হয়েছে। এখন বেশ ঝকঝকে।

মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক গৌতম রায় নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জে ফিরে বোসের কেবিনে যেতে ভুললেন না। বাংলানিউজকে বলেন, এখানে এলে সবার সঙ্গে দেখা হয়। নারায়ণগঞ্জের প্রাণ এই বোসের কেবিন।

ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দে ধুলো উড়িয়ে চলে যায় ট্রেন। নারায়ণগঞ্জ ১ ও ২ নং রেলগেটের মাঝখানে বোসের কেবিনের আড্ডায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। সন্ধ্যা বাড়তে থাকে বোসের কেবিনে, ইতিহাসের বোস কেবিনে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৬
এমএন/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।