স্থানীয় বিভিন্ন গ্রাম তো বটেই, দেশের নানা প্রান্ত থেকেও শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক, যুবা, তরুণ-তরুণীর ঢল ছিলো বিলমুখী!
মাইকিং বা বল প্রয়োগ করেও হটানো যায়নি রহস্যময় ‘মগজ ধোলাইয়ের’ শিকার ওইসব মানুষজনকে। ভ্রান্ত বিশ্বাসের সেই শেকড় পুরোমাত্রায় মূলোৎপাটন করা সম্ভব না হলেও সপ্তাহের ব্যবধানে এই সংখ্যাটা অনেকটাই কমেছে।
মূলত সামাজিক সচেতনতার ফলেই ‘গুজব বিল’ হিসেবে নতুন করে পরিচিতি পাওয়া স্থানীয় চেচুয়া বিলে আপাতত ঠেকানো গেছে অন্ধ বিশ্বাসী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। যদিও এখনো ‘কল্পলোকে বসবাস’ করা অল্প স্বল্প মানুষের উপস্থিতি রয়েছে বিলটিতে।
স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন এদিকটায় চোখ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগে দিনমান জেলার ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের চেচুয়া বিলের পানিতে আবারো ডুব দেওয়া থেকে শুরু করে নোংরা পানি পানকারী ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের আনাগোনা চলছেই।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, কারা গুজব ছড়িয়ে সরল বিশ্বাসী মানুষদের সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদ পেতে রীতিমতো এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিলো, এই চক্রটিকে খুঁজে বের করতে এখনো জোরালো উদ্যোগ নেই স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।
সোমবার (১৫ অক্টোবর) ঘণ্টা কয়েক বিলটিতে অবস্থান করে গ্রামটির স্থানীয় বাসিন্দা, কঠিন রোগ ভালো ও মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার আশায় এখানে আসা সরল মনের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেলো এমন সব চিত্রের।
ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরের এই বিলমুখী মাটির সড়কে পা ফেলতেই দেখা হলো তিন যুবকের সঙ্গে। ওদের একজন হারুন অর রশিদ (৩০)। বাড়ি দিনাজপুর জেলায়।
বিলের পানিতে ডুব দিলে কঠিন রোগ ভালো হবে এবং মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে এমন বিশ্বাসেই এসেছেন এখানে।
গোসল শেষে স্ত্রীর জন্য বিলের নোংরা পানি বোতলে ভরে হেঁটে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। হারুনের সঙ্গে থাকা দুই যুবক হাবিবুর রহমান (৩২) ও মিন্টু মিয়ার (৩০) বাড়ি আবার ফুলবাড়িয়া উপজেলায়।
আলাপচারিতায় হাবিবুর জানান, গত ৭ থেকে ৮ দিন আগেও এই বিলে অসংখ্য যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজ করেছেন। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮শ’ টাকা করে ভাড়া মেরেছেন। টাকা উপার্জনের নেশায় বিলের পানিতে সেই সময় ডুব দেওয়া হয়নি।
এখন লোকজনের আনাগোনা কমে যাওয়ায় নিজেরাই বিলটিতে গোসল ও পানি নেওয়ার কাজ সারছেন। তাদের বিশ্বাস- ‘এতো মানুষ মিছে মিছে এমনটি করতে পারে না। ’
হারুন, হাবিব ও মিন্টুদের সঙ্গে আলাপের সময়েই আগ বাড়িয়ে যোগ দিলেন স্থানীয় বিরামপুর খাবলাপাড়া এলাকার সেলিনা খাতুন (৪০)। এই নারীর দাবি- ‘কোন ডাক্তরের (ডাক্তার) অষুধ (ওষুধ) কাজে লাগে নাই। বিলের পানিতে গোছল (গোসল) করছি, পানি খাইছি (খেয়েছি), অহন পায়ের ফুলা কমছে, দিব্যি ভালা (ভালো) আছি। ’
স্থানীয় চেচুয়া বিলটিকে ঘিরে সেলিনার মধুর গুণকীর্তনের স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দারাও জড়ো হতে থাকেন। তবে ফুৎকারে তার এমন বক্তব্যকে উড়িয়ে দিলেন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম।
পাল্টা উদাহরণ দিয়ে জাহাঙ্গীরের ভাষ্য- ‘আমার গ্রামের মূসা নামের এক লোক প্যারালাইসিসে (পক্ষঘাত) আক্রান্ত ছিলেন। গুজবে তার পরিবারের লোকজন তাকে বিলে এনে গোসল করিয়েছিলেন। পানি খাইয়েছিলেন। কাজের কাজ কিছু হয়নি। এসব আসলে গুজব। এই ডিজিটাল যুগে মানুষ ভ্রান্ত বিশ্বাসে এমন কাজ করতে পারে, চেচুয়া বিল না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।
তবে গত কয়েক দিনে গুজবে কান দেওয়া মানুষের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বিরামপুর উজানপাড়া গ্রামের সোহাগ হোসেন (৩২)। তিনি জানান, জন্ম থেকে দু’পাক বাঁকা বা বাক প্রতিবন্ধী সপ্তাহ আগেও এমন মানুষের ভিড় ছিলো বেশি।
ওই সময় মানুষ দেদারছে নোংরা ও কাদাযুক্ত পানি খেয়েছে। এখন তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তবে পুলিশ এখনো তৎপরতা অব্যাহত রাখলে কেউ আর বিলের পানিতে নামার সাহস করতো না, যোগ করেন এই গৃহস্থ।
এই ‘গুজব বিল’কে ঘিরে পুলিশের দৃষ্টি ও পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখন দিনে কিছু সংখ্যক মানুষ বিলে যাতায়াত করছে। ফলে আমরা সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এছাড়া শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে আমাদের কঠোর নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে।
গুজব ছড়ানো চক্র শনাক্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি। তবে গুজবকারীদের শনাক্ত করতে একজন উপ-পরিদর্শককে (এসআই) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পূজা শেষ হলে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৮
এমএএএম/জেডএস