ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘সকালে দেখবা আমি কী করি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৮
‘সকালে দেখবা আমি কী করি’ সীমার নবজাতক সন্তান। ছবি-বাংলানিউজ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ‘যা তরে দিয়া যামু। সকালে দেখবা আমি কী করি।’ তিনদিনের ছেলেকে পাঁচ তলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে হত্যার পর একই ভাবে আত্মহননের আগের রাতে এভাবেই কারো সঙ্গে ফোনে ঝগড়া করেছিলেন সীমা আক্তার (২৫) । 

সিজারিয়ান অপারেশনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে ৩০২ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন ছিলেন সীমা। তার পাশের ৩০৩ নম্বর কক্ষে থাকা ফরিদা খাতুন বলেন, শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) সকালে আত্মহননের আগের রাতে দীর্ঘ সময় সীমা কার সঙ্গে যেন মোবাইল ফোনে ঝগড়া করেছিলেন।

তার ছেলেটিও রাতভর চিৎকার করেছে। কাকে যেন সীমা মোবাইল ফোনে বলছিলেন, ‘যা তরে দিয়া যামু। সকালে দেখবা আমি কি করি। ’ 

শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) সকালে ওই হাসপাতালের পাশে অবস্থিত দি ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড স্পেশালাইজড হাসপাতালের পাঁচ তলার ছাদ থেকে ছেলেকে ফেলে হত্যার পর নিজেও গড়িয়ে পড়ে জীবন দেন সীমা।

জানা গেছে, শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে জেলা শহরের পুরাতন জেলা রোডের দি ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এন্ড স্পেশালাইজড হাসপাতাল ভবনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সীমা আক্তার নামে ওই গৃহবধূ ওই ভবনের পাশের লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের ৩০২ নম্বর কক্ষে ভর্তি ছিলেন।

সীমা সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের ঘাটিয়ারা ফুলচং গ্রামের লেবানন প্রবাসী মনির হোসেনের স্ত্রী। এক বছর আগে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। প্রায় আট মাস আগে মনির লেবাননে যান।  

সীমার বাবা আখাউড়া উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের কল্যানপুর গ্রামের শ্যামায়ন মিয়া বলেন, ‘পারিবারিকভাবে যৌতুক ছাড়াই সীমার বিয়ে হয়। ছেলে পক্ষও কোনো কিছুর দাবি করেনি তখন। আমরা আর্থিকভাবে খুবই অস্বচ্ছল হওয়ায় বিয়ের সময় সীমাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি। কিছু দিতে না পারার কারণে শ্বশুরবাড়ির লোকজন সীমাকে সব সময় মানসিক নির্যাতন করতেন। ’  

তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনার আগের রাতে বাবার বাড়ি থেকে কিছু দেওয়া বিয়য়টি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সীমার ঝগড়া হয়। এসময় সম্ভবত মনির হাসপাতালের বিল দিতে পারবে না বলে জানায় এবং শিশুটির পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এজন্য সীমা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। ’ 

সীমার দাদি আমেনা খাতুন ডিংরাজের অভিযোগ, সীমা বাবার বাড়ি আসতে চাইলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনুমতি দিতে চাইতেন না। শ্বশুরবাড়িতে অনেকের অনুমতি নিয়ে চলতে হতো তাকে।  

তিনি বলেন, ‘গরিব বইল্যা নাতিনডারে কইছিলাম কোনো মতে সংসারটা করতে। মরছে পরেও শ্বশুরবাড়ির কেউ একবার আইয়্যা দেখছে না। ’

আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্য সালমা বেগম বলেন, ছেলে পক্ষের যৌতুকের দাবি না থাকলেও কিছু দিতে না পারার কারণে মেয়েটাকে তারা প্রায়ই অপমান করতেন। সীমা তার দাদিকে প্রায় বলতো, আমারে বিয়া দিছ একটা স্বামীর কাছে আর আমার এহন ১২ জন গার্জেন বিছাইরা বাইরা কইরা বাড়িত আওয়ন লাগে (অনেক অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে আসতে হয়)।  

নিহতের স্বামী মনিরের বড় ভাই শামীম ভূঁইয়ার স্ত্রী লায়লি আক্তার বলেন, বিয়ের সময় সীমা বাবার বাড়ি থেকে একটি আংটিও আনেনি। সব ঠিকই ছিল। মনিরের সঙ্গে সীমার কোনো ঝগড়া হয়নি।  

এদিকে, হাসপাতালের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও পথচারীদের কাছে থাকা মোবাইলের ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, গত শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে নবজাতক ছেলেকে কোলে নিয়ে সীমা ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ এদিকে-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে লাইফ কেয়ার হাসপাতালের ভেতরের সংযোগ সিঁড়ি দিয়ে পাশের দি ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড স্পেশালাইজড হাসপাতালে যান। ওই হাসপাতালের পাঁচ তলার ছাদে উঠে  নবজাতককে নিচে ফেলে দেন। এসময় রাস্তায় থাকা লোকজন তাকে লাফ দিতে নিষেধ করতে থাকলেও মুহূর্তের মধ্যেই হাসপাতালের ছাদে শুয়ে তিনি গড়িয়ে নিচে পড়ে যান। এতে ঘটনাস্থলেই মা-ছেলের মৃত্যু হয়।
 
পুলিশ, নিহতের পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর প্রসব ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর রাতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সীমা একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। শুক্রবার ৯টার দিকে তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল।

হাসপাতালের বিল দিতে না পেরে সীমা এ কাজ করেছেন বলে প্রথম দিকে শোনা গেলেও অনুসন্ধানে এর কোনো সত্যতা মেলেনি।  

এ বিষয়ে কথা হয় হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন খানের সঙ্গে। বিল সংক্রান্ত জটিলতার কথা অস্বীকার করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রোগীর হাতে কোনো বিল দেইনি। বিল দেওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টার পরে। আর ঘটনাটি ঘটেছে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দাম্পত্য কলহের জের ধরে ওই নারী আত্মহনন করেছেন বলে মনে হচ্ছে। এ ঘটনায় শুক্রবারই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন।  ঠিক কোন কারণে মেয়েটি এমন কাজ করেছে তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। তবে, তার মোবাইল ফোনের কললিস্টের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কললিস্ট পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।