বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) দুপুর দেড়টা থেকে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব। চলবে সন্ধ্যে পরযন্ত।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে এবার দু'দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ দিন রামু বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদ এ উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হলেও সনাতন, মুসলিম এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অংশ গ্রহণে উৎসবস্থল সাম্প্রদায়িক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
দুপুরে অনুষ্ঠান স্থলে দেখা গেছে, মূলত সিংহ ও ময়ূরকে বন-জঙ্গলে এবং ঘোড়াকে এতোদিন আমরা স্থলভাগে দেখলে এ উৎসবে দেখা গেলো পানিতেই ভাসছে এই তিনটি প্রাণী। এমন কি আকাশ ছাড়িয়ে পাখিও পানিতে। এছাড়াও ২৮ বুদ্ধের আসন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডার আকৃতিতেও দৃষ্টি কল্প জাহাজ তৈরি করা হয়েছে। আর এসব জাহাজে চলছে শিশু-কিশোর ও যুবকদের বাঁধভাঙা আনন্দ। নানা বাদ্য বাজিয়ে তারা নাচছে আর গাইছে। নদীতে ভাসতে ভাসতে জাহাজগুলো যাচ্ছে নদীর এপার থেকে ওপারে। মাইকে বাজছে-বুদ্ধ কীর্তন-‘বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের নাম সবাই বলো রে’ বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’। পাঁচ-ছয়টি নৌকার উপর বসানো হয়েছে এক-একটি কল্প জাহাজ। রঙ-বেরঙের কাগজে আকর্ষণীয় নির্মাণ শৈলীর কারণে খুব সহজেই মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে এসব জাহাজ।
প্রতিটি জাহাজেই বাজছে একাধিক মাইক, ক্যাসেট প্লেয়ার। ঢোল, কাঁসর, মন্দিরাসহ নানা বাদ্যের তালে তালে জাহাজে শিশু কিশোর ও যুবকেরা মেতে ওঠেছে এক অন্য রকম আনন্দে। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনের ফুলকি বের করার দৃশ্যটিও বেশ উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা।
সন্তানকে নিয়ে উৎসবে যোগ দিতে কক্সবাজার থেকে এসেছেন ড. আছিং রাখাইন। আছিং বললেন, অনেকদিন ধরে রামুর এ উৎসবের কথা শুনে আসছি। কিন্তু পড়ালেখার সুবাদে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় আসা হয়নি। এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না, এ উৎসবের রূপ কেমন। সত্যিই অসাধারণ। কক্সবাজারে একটি আন্তজার্তিক সাহারয্য সংস্থায় কাজ করেন বিশ্বজিৎ বড়ুয়া। উৎসবে আসেন কিছু বিদেশী সহকর্মীদের সঙ্গে।
তিনি আরো বলেন, ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি, সেই রামুতেই এখন দেখছি, এক অন্যরকম আনন্দ উৎসব। সত্যিই খুব ভাল লাগছে। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বাংলানিউজকে জানান, আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূণির্মা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাব্রত পালনের শেষ দিনই হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা। এদিনটি অত্যন্ত জাকালোভাবে পালন করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এ ধারাবাহিকতায় এখানে জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন।
তিনি বলেন, প্রায় দুইশো বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ জাহাজ ভাসা উৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, যুগ যুগধরে হাজার হাজার শিশুকিশোর ও আবাল বৃদ্ধবণিতার মাঝে নির্মল আনন্দ এবং সৌহার্দ্য সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে আসছে। একসময় খুরুস্কুল ও চৌফলদন্ডী এলাকার রাখাইন সম্প্রদায় সাগরের মোহনায় এ উৎসব জাকালোভাবে পালন করতো। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার কারণে বিগত কয়েক বছর এখানে জাহাজ ভাসানো উৎসব বন্ধ রাখা হয়। এখন ছোট্ট পরিসরে হারবাং ও চৌফলদন্ডীতে এ উৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতোটা বর্ণাঢ্য রূপ সেখানে দেখা যায় না।
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি, রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, আজ থেকে দুইশো বছর আগে থেকে এ জাহাজ ভাসানো উৎসবের প্রচলন হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। মিয়ানমারের মুরহন ঘা এলাকায় একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবেরর আয়োজন করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার একসঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এ আয়োজন চলতো। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এ উৎসবের প্রচলন। প্রায় শতবছর ধরে, রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।
দুপুর দেড়টায় এ উৎসবের পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন উখিয়া পাতাবাড়ি আনন্দভূবন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবোধি মহাথের। উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের পরিচালক করুণাশ্রী থের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন, রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. লুৎফর রহমান, কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাথিং অং, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, রামু বৌদ্ধ ঐহিত্য ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি ও প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু প্রমুখ।
শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কেতন বড়ুয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৮
এএটি