বর্তমান সরকার তাদের অনগ্রসর দলিত সম্প্রদায়ে অধিভুক্ত করেছে। তবে মোদ্দা কথা-কালের বিবর্তনে কেবল নাম ও পরিচয়েরই হেরফের হয়েছে তাদের।
সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের ভোগ বিলাসের যোগান দিতে গিয়ে তারা নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায়। যেনো মানুষ হয়ে আজও ‘অচ্ছুত’ হরিজন পল্লির বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানসহ নানা সংকটে যেন না মরে বেঁচে আছেন এ পল্লির বাসিন্দারা। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা চরম বঞ্চনার শিকার। নিজ সমাজের কাছেই অস্পৃশ্য তারা। তাদের এই করুণ জীবনের গল্পগুলো যেন শোনার মতো সময়ও নেই কারও। অথচ তারাই শহরের নোংরা-আবর্জনা ঘাটার অসাধ্য কাজটি করে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলছেন নগরজীবনকে।
রাজশাহী শহরের ঠিক মাঝখানেই হেতমখাঁ এলাকা। সেখানে রয়েছে হরিজন পল্লি। যেখানে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১১নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় চার বিঘা জমির ওপর স্বাধীনতার আগেই গড়ে ওঠে এই হরিজন পল্লি। মহানগরীর এই হরিজন পল্লিতে সরজমিনে গেলে চোখের সামনে ফুটে ওঠে তাদের যাপিত জীবনের করুণ চিত্র।
হরিজন পল্লির উপ-মল্ডল (সেক্রেটারি) ডাবলু হেলা জানান, প্রায় পাঁচশ’ পরিবারের তিন হাজারেরও বেশি মানুষ গাদাগাদি করে থাকে এই পল্লিতে। তাদের আবাসন ব্যবস্থা সাধারণ বস্তির মতো নয়। সেখানে টিনশেড আধাপাকা বাড়ি তৈরি করা আছে।
তবে জরাজীর্ণ সেই বাড়ির চারপাশে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করার কোনো ডাস্টবিনের নামগন্ধও নেই! চার-পাঁচটি পরিবারের সদস্যরা একটি টয়লেট ব্যবহার করেন। নেই সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থাও। পুরো পল্লিতে রয়েছে মাত্র একটি টিউবওয়েল। তাতেও আবার পানি ওঠে না!
হরিজন পল্লির বাসিন্দা শ্রী গোপাল বলেন, ঘুপচির মধ্যে তৈরি করা একটি ঘরের মধ্যে কেবল কাপড় বা চাদর টানিয়ে আরও তিন থেকে চারটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। যেনো স্ত্রী, ছেলে সন্তান নিয়ে কোনোভাবে মাথা গোঁজা যায়। ঘরের মধ্যে নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থাও। তাই শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা বলে কোনো কথা নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট্ট ঘরের মধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ বিরাজ করে বছরের পুরো সময়জুড়েই।
বাসিন্দারা জানালেন, এখন এখানকার মানুষের কাজের কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই সেখানকার সবচেয়ে বড় সমস্য এখন বেকারত্ব। অনেক লড়াই সংগ্রাম করে এখানকার ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হয়।
আর পরিচয় গোপন করে পা বাড়াতে হয় মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে। কারণ পরিচয় গোপন না করলে একই গ্লাসে পানি পান করা তো দূরের কথা শ্রেণিকক্ষে পাশে বসতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না তাদের। এরপরও কোনোভাবে শিক্ষিত হলেও তারা হরিজন বলে চাকরি পান না বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের।
গোপালের ভাষ্য, হরিজন পল্লির বসবাসরতদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে প্রতিবেশীরাও কখনো তাদের বাড়িতে পা রাখে না। তাদের শিশুদের সঙ্গে নিজেদের শিশুদের মিশতে দেওয়া না, খেলতে দেয় না, নিজেরা কথা পর্যন্ত বলে না। জাত-পাতের বিভাজন আর সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার কারণেই তারা সবার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন।
হরিজন বিজয় বয়েজ ক্লাবের সভাপতি ও হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সহকারী মন্ডল হরিলাল বাবু বলেন, আমরা কেবল সরকারি বরাদ্দের কথা শুনি। কিন্তু কখনও চোখে দেখি না। তাই বরাবরই তারা সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
তিনি জানান, দেশের অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় হরিজনদের কোনো বিদ্যুৎ বিল দেওয়া লাগে না। অথচ আমাদের দিতে হয়। একটি প্রাথমিক স্কুল আছে। কিন্তু আজও তার কোনো উন্নয়ন হয়নি। একটি ছোট্ট মন্দির রয়েছে। সেখানেও কোনো অনুদান পাওয়া যায় না।
হরিলালের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের জন্য কোনো কাজ করেননি।
কথা হয় মহানগর হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি বসন্ত লালের সঙ্গে। তার বয়স এখন নব্বই। জানান, বার্ধক্যের সব রোগ ঘিরে বসেছে তাকে। রোগ-বালাই নিয়েই পরিবারের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ছুটতে হয় তাকে। পেশায় তিনি একজন সুইপার। এক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝাড়ুদার পদে চাকরি করলেও বয়সের কারণে সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে বসে থেকে সংসার চালাতে চালাতে পেনশনের টাকাগুলোও শেষের পথে। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও বসন্ত লালের কপালে জোটেনি বয়স্ক ভাতার কার্ড। কারণ তিনি হরিজন!
প্রধান সমস্যা কি? জানতে চাইলে বসন্ত লাল বলেন, ‘আমরা যাযাবরের মতো থাকি। ঘরে ঢুকতে যদি খেয়াল না করেন তাহলে ভাঙা টিনে মাথা কেটে যাবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখা-পড়া শিখলেও কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায় না। তারা নিচু জাতের। তাই বেকারত্বই এখন বড় সমস্যা।
পল্লি বাসিন্দাদের অভিযোগ, কখনও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুইপারের সার্কুলার হলেও সাধারণ মানুষ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে হরিজনের সনদ নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। প্রকৃত হরিজনরা সেই চাকরি থেকেও বঞ্চিত হন। তাই তাদের জীবন যেন শাখের কড়াতের মতো হয়ে গেছে।
বসন্ত লাল বলেন, এ কারণে ছেলে-মেয়েরা কোনো কাজ না পেয়ে একটা সময়ে এসে বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। এক সময় তারাও একই কাজে লিপ্ত হয়। আর এভাবেই কেটে যায় তাদেন জীবন।
বাংলাদেশ সময়: ০২৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৮
এসএস/এমএ