ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিলুপ্তপ্রায় ‘পটগান’ উজ্জীবিত খুলনায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৮
বিলুপ্তপ্রায় ‘পটগান’ উজ্জীবিত খুলনায় পটগান পরিবেশন করেছে রূপান্তরের শিল্পীরা।

খুলনা: পটুয়া শিল্পীদের এক অনন্য সৃষ্টি পটগান। এক সময় বিষয়ভিত্তিক পটচিত্র দেখিয়ে পটের গান গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। কালের বিবর্তনে বাংলা লোকগীতির এই ধারাটি বিলুপ্তির পথে। মোটা দাগে বলতে গেলে কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পটুয়াদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

প্রায় হারাতে বসা এ পটগান খুলনায় আবারও ফিরে এসেছে নতুন রূপে। বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পটগানকে এখন ব্যবহার করছে উন্নয়ন যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে।

বিশেষ করে রূপান্তর নামে খুলনার উন্নয়ন সংস্থা পটগানকে নতুন করে তুলে এনে একে আবার জনপ্রিয় মাধ্যমে পরিণত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে সব পটচিত্র কাপড়েই আঁকা হতো। ধর্মীয় বিষয় কিছু ছবির মাধ্যমে বয়ান করা হতো। আবার কিছু পট ছিল যমের ভয় দেখানোর জন্য।

অতীতে সুন্দরবন সন্নিহিত খুলনার পটগানের মূল বৈশিষ্ট্য সুন্দরবনভিত্তিক থিম নির্ভর ছিল। পটের আখ্যানভাগ ছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোককাহিনী ভিত্তিক। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু যেমন বাল্য বিয়ে, মাদক, নারী শিক্ষা, দুর্যোগ প্রভৃতির সচেতনতার জন্য পটগান প্রচলিত রয়েছে।

দিন যতই যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা পটগান খুলনাঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। ফিরে পাচ্ছে হারানো ঐতিহ্য। বিশেষ করে গাঁয়ের প্রান্তিক নিরক্ষর মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিতভাবে পটগান উপভোগ করছেন। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শকদের কাছে পটগান এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় আয়োজন।

পটগানের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পটগান ১৯৬০ সালের পর থেকেই বিলুপ্ত হতে শুরু করে। পটুয়ারা পটগান দেখিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিলেন না। এ কারণে তারা পটগান পরিহার করতে শুরু করেন। খুলনাঞ্চলে বিগত শতকের শেষ দশকে রূপান্তর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করতে গিয়ে ১৯৯৪ সালে মোংলা অঞ্চলে এ বিলুপ্তপ্রায় পটগানের সন্ধান পায়।

সংস্থার প্রধান নির্বাহী স্বপন গুহ এবং পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকনের অভিজ্ঞ চোখ বুঝে নেয় এ মাধ্যমটির কিছু পরিবর্তন করলেই তা উন্নয়ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। তারা এলাকায় আয়োজন করলেন পটগান প্রতিযোগিতার। আর তাদের এ কাজে উৎসাহিত করেছিলেন মোংলা এলাকার প্রবীণ শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী কৃষ্ণপদ অধিকারী। রাতে পোর্টেবল জেনারেটরের আলোয় ভিএইচএস ক্যামেরায় ধারণ করা হয় সে পটগানের প্রতিযোগিতার পুরোটা। পটগান পরিবেশন করেছে রূপান্তরের শিল্পীরা। পটগান বিষয়ে ধারণা নেওয়া হলো, তৈরি হলো উন্নয়ন যোগাযোগে পটগানের ব্যবহারের প্রাথমিক চিন্তা। কিন্তু কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেলো পটগান লেখা এবং সুর করা খুব সহজ কাজ নয়। বানিয়ার চর থেকে সংগ্রহ করা হলো লোককবি ইলিয়াস ফকিরকে। এবারে চললো ঘষামাজার পালা। চাহিদা অনুযায়ী গান লিখে সুর করলেন ইলিয়াস ফকির। শিল্পীকে দিয়ে বড় ক্যানভাসে আঁকানো হলো গানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রয়োজনীয় চিত্র। তৈরি করা হলো পটগানের দল। তারপর মহড়া শেষে পরিবেশনা।

রোববার (৪ নভেম্বর) রূপান্তরের তথ্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম বাংলানিউজকে বলেন, রূপান্তর প্রথম পটটি উপস্থাপন করে ১৯৯৮ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায়। পটগানটিও তৈরি হয়েছিলো সুন্দরবন ও পরিবেশ ঘিরে। পরবর্তীতে রূপান্তর পটগান নিয়ে আরো বিভিন্নভাবে গবেষণা করে। রূপান্তরের পটগানগুলো কোনো পৌরাণিক কিংবা অলৌকিক কাহিনী নিয়ে নয়, এটি আসলে উন্নয়ন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রূপান্তর ব্যবহার করছে। যে কারণে অনেক বেশি দর্শককে একসঙ্গে দেখানো এবং তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পটচিত্র, সুরের বৈচিত্র্য ও উপস্থাপনের ভঙ্গিও অনেকখানি পরিবর্তন করা হয়েছে। পটগান পরিবেশন করেছে রূপান্তরের শিল্পীরা। ১১ হাজারের উপর পটগানের প্রদর্শনী ইতোমধ্যে কোটির বেশি মানুষ দেখেছেন। শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই নয়, রূপান্তর তাদের পটগানের প্রদর্শনী করেছে সুইডেন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভারতে। সবখানেই এ পটগান প্রশংসিত হয়েছে। পটগানের বাংলা বাণী না বুঝেও দর্শকরা ছবি থেকে তার মেসেজটি ঠিকই ধরে নিতে পেরেছেন।

রূপান্তরের প্রযোজনা সমন্বয়কারী পটগান শিল্পী আখতারুন্নেছা নিশা বাংলানিউজকে বলেন, একটি পটগানের দলে ১১-১৩ জন শিল্পী থাকে। পটগানের জন্য বাঁশি, হারমনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা, জিপসি, দোতারা লাগে। দেশের ৬৪ জেলায় আমরা পটগান পরিবেশন করি। সরকারি যে কোনো দিবসে পটগান থাকে।

তিনি জানান, দেশের বাইরেও পটগান পরিবেশন করা হয়েছে। চীন, ভারত, লাওস, সুইডেনে পটগান পরিবেশন করেছে রূপান্তরের শিল্পীরা।

সঙ্গীত অনুরাগী খুলনার সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক বিকাশ রায় বাংলানিউজকে বলেন, পটগানে মূলত সময়কে ধরে রেখে স্মৃতিচারণ করা হতো। অশিক্ষিত জনসাধারণ লেখার বদলে ছবি এঁকে বিভিন্ন ঘটনাকে ধরে রাখতো। পরে সেই ছবি অনুযায়ী গান রচনা করে গাওয়া হতো ছবি প্রদর্শনের সময়। এতে ইতিহাস সংরক্ষিত হতো। তাই লোকসংস্কৃতিতে পটগানের মূল্য যেমন, ইতিহাস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তেমনি বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে।

তিনি জানান, আগে নানান বিষয় নিয়ে পটগান হয়ে থাকতো। এর মধ্যে গাজী পীর, রামলীলা, কৃষ্ণলীলা বেশি জনপ্রিয় ছিল। গাজীর গান বলে লোকসঙ্গীতের যে ধারাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, সেটি মূলত পটগান। সেখানে গাজীর পরিচয়, কর্ম, লীলা, অলৌকিক ক্ষমতা ইত্যাদি বিধৃত করে পট আঁকা হতো। সেই পট দেখিয়ে গাজীর গান গাওয়া হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পটগানের প্রেক্ষাপটেও পরিবর্তন এসেছে।

রূপান্তরের প্রধান নির্বাহী স্বপন গুহ বাংলানিউজকে বলেন, বাঙালি ঐহিত্যবাহী একটা লোকমাধ্যম হলো পটগান। যে লোকমাধ্যমটি হারিয়ে গেছিলো সেই মাধ্যমটি আবার ফিরে এনে সারা বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ছিল পটগানকে পুরনায় ফিরিয়ে আনার একটি উদ্দেশ্য। আর একটি উদ্দেশ্য ছিল পটগান এমন একটি মাধ্যম যেটিকে যে কোনো ভাষায় যে কোনো দেশের লোকশিক্ষায় ব্যবহার করা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন চীন, লাওস, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের দেশের ঘটনা কেন্দ্র করে তাদের ভাষায় ও সুরে পটগান পরিবেশন করেছে রূপান্তরের শিল্পীরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৮
এমআরএম/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।