যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাকিস্তানকে যুদ্ধের আগে শান্তির প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসর্মপণ করতে চিঠি দেওয়া হবে।
কেউ মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে রাজি নন, অবশেষে রাগই করলেন বিগ্রেডিয়ায় হরদেব সিং। ওই সময় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানে ব্যারাকে ঢুকতে রাজি হয় বশির আহাম্মেদ নামে এক কিশোর।
সেই সাহসী বশির আহাম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, রাতে সিদ্ধান্ত হয়, আত্মসমর্পণের চরমপত্র পাঠানো হবে। তবে, কে নিয়ে যাবেন সেটা সিদ্ধান্ত হয়নি। সকাল বেলা, হালকা শীত, সবাইকে ডেকে নিয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলো, কিন্তু পত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউ রাজি হলেন না। একপর্যায়ে রাগ করলেন বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং। সবাইকে ভীতু ও কাপুরুষ বলে আখ্যা দেন তিনি। ওই সময় আমি ছিলাম একটু দূরে। পরে কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। এক হাতে সাদা পতাকা, অন্য হাতে আত্মসর্মপণের চিঠি, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাই হানাদার বাহিনীর ডেরার দিকে। প্রতিটি কদমে কদমে আল্লাহ আল্লাহ করতে এগিয়ে চলি। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে উড়াই সাদা পতাকা। সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে অসীম সাহসে ঢুকে পড়ি পাকিস্তানের ক্যাম্পে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চিঠিটি ক্যাপ্টেন আহাসান মালিকের হাতে দিই। চিঠি নিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়। খাবারও দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। ঘণ্টা দু’য়েক পরও কোনো উত্তর না পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকটি বিমান চক্কর দেয় আকাশে। একপর্যায়ে প্রায় ২০ মিনিট ধরে ভারতীয় বিমান থেকে চলে বোমা বর্ষণ। বেলা ১টার দিকে আনিসুল হক সঞ্জু নামে আরেক মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে চরমপত্র পাঠায় যৌথ বাহিনী। তাকেও বসিয়ে রাখা হয়। বেলা ২টার দিকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকটি বিমান আবারও কামালপুরের আকাশে চক্কর দিলে পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন আহাসান মালিক আত্মসমর্পণে রাজি হন। তারও সাদা পতাকা নিয়ে মাঠে এসে বিমান বাহিনীর পাইলটকে দেখালে বিমানগুলো দ্রুতই চলে যায়। পরে ক্যাপ্টেন আহাসান মালিক চিঠির উত্তর দিয়ে দেন। সেই চিঠি নিয়ে বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লিয়ারের হাতে দিতেই আনন্দ ফেটে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নগাদ ১৪০ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্যকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন ক্যাপ্টেন আহাসান মালিক।
কামালপুরে উড়তে থাকে বিজয় পতাকা। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের এ অঞ্চলই প্রথম মুক্তির স্বাদ পায়।
যে কারণে ঐতিহাসিক কামালপুর: আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জামালপুর জেলার ধানুয়া কামালপুরই প্রথম হানাদার মুক্ত হয়। কামালপুর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে মহেন্দ্রগঞ্জে ছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর। এ ফ্রন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এছাড়া ১১ বার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন মুক্তিযোদ্ধারা। কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প। এ সেক্টরে মোট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ২২ হাজার। ১২ জুন থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন সময়ে ১১ বার সম্মুখযুদ্ধ হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ মোট ১৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এখানে। পাকিস্তানিদের ৪৯৭ জন সেনা নিহত হন। কামালপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা সভা ও র্যালির আয়োজন করেছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৮
এসআই