অসংখ্য বাংলা জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে নিয়ে এভাবেই বলছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। বুলবুলের লেখা ও সুরে গাওয়া তার অনেক গান শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয় সুরকার, গীতিকার ও মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ। সেখানে গুণী এ শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ।
সেখানে প্রথমেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে এ মুক্তিযোদ্ধার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন। এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বুলবুলের দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা শেষবারের মতো তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর বলেন, নতুন যারা আসবে তারা যেন অবনত মস্তকে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, আজকের এ দিনে এটুকুই প্রত্যাশা।
কণ্ঠশিল্পী মনির খান বলেন, আমি তাকে মামা বলে ডাকতাম। তিনি মাটির মানুষ ছিলেন। সংগীতের মানুষ হিসেবে সারা পৃথিবীতে সুনাম অর্জন করেছেন ঠিকই, কিন্তু একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার সঙ্গে প্রায় তিন শতাধিক গানে কাজ করেছি। অসংখ্য ভালো ভালো গান করেছেন তিনি। কখনও অডিও অ্যালবামে কাজ করেননি, চলচ্চিত্রে কাজ করতে ভালোবাসতেন, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সংগীতের বিষয়গুলো পরিস্কারভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য উপযোগী একজন মানুষ ছিলেন বুলবুল মামা।
প্রখ্যাত গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, সংগীত জগতে তার অসামান্য অবদান। বিশেষ করে দেশাত্মবোধক গানকে তিনি যে মাত্রা দিয়েছেন, তা উল্লেখ করার মতো। তার লেখা এবং সুরে বাংলা গান উচ্চতম এক মাত্রা পেয়েছে। সেগুলো মানুষের হৃদয়কে শান্ত করে আপ্লুত করে।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, এতদিন যে বুলবুলকে দেখেছি আর এখন আজকে যা দেখছি তার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সৃষ্টিকর্মের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। আমরা সেটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেব।
কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আমাদের জন্য সংগীতের জন্য একজন বটবৃক্ষ হয়ে ছিলেন। আমরা সেই ছায়াটাকে হারিয়ে ফেললাম।
আর, সৃষ্টিশীল জগতে তার যে অনবদ্য অবদান, তা জাতি দীর্ঘদিন মনে রাখবে বলে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
তিনি বলেন, সুরের জগতে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তার অনুপ্রেরণা, প্রভাব দীর্ঘদিন জাতির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রভাবিত হবে। তার মত কাউকে পেতে আরো অনেক অনেক দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছেলে আসিফ ইমতিয়াজ মুন বলেন, বাবাকে আজকে যে শ্রদ্ধা করা হয়েছে তিনি তার যোগ্য দাবিদার। গীতিকার ও সুরকারের চেয়ে বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে হিসেবে দেশের জন্য যা করা প্রয়োজন তিনি তা করেছেন। এবার আপনাদের করতে হবে। আপনারা বাবার জন্য দোয়া করবেন।
শত জনমের এ আয়োজনে বরেন্দ্র শিল্পীর প্রতি আরও শ্রদ্ধা জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বসন্ত উৎসব উদযাপন পর্ষদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, উদীচী, সমস্বর, বাংলার ঢোল, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, পরম্পরা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সদস্যরা, বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধারাসহ হাজারও মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বেলা ১টায় মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। মসজিদ প্রাঙ্গণে বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম জানাজা। জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বরেণ্য এ শিল্পীর মরদেহ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
অসংখ্য বাংলা জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার (২২ জানুয়ারি) ভোরে রাজধানীর আফতাব নগরে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সংগীত ও শিল্পাঙ্গনে। তার অকালে চলে যাওয়া সহকর্মীদের কেউ মেনে নিতে পারছেন না। শোকে স্তব্ধ সবাই।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে 'মেঘ বিজলী বাদল' ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীর গাওয়া বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তার নিয়মিত গান করা। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন।
১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্ম নেওয়া বুলবুল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে বহু জনপ্রিয় গান লিখেছেন ও সুর করেছেন তিনি।
‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘আয় রে মা আয় রে’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’-এমন বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা এ শিল্পী।
তিনি প্রেমের জন্য লিখেছেন- 'আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি', 'ভাড়া কইরা আনবি মানুষ', 'প্রেমের তাজমহল'সহ আরও বহু জনপ্রিয় গান।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৯
এইচএমএস/ওএইচ/