ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রান্না ঘরে মৌলিক স্বাক্ষরতার সাইনবোর্ড!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯
রান্না ঘরে মৌলিক স্বাক্ষরতার সাইনবোর্ড! মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের সাইনবোর্ড। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: কাগজ-কলমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও বাস্তবে রান্না ঘরে শোভা পাচ্ছে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের সাইনবোর্ড। দেড় মাসেও ক্লাস চালু না করাসহ নানা অনিয়মের জবাব চেয়ে বাস্তবায়নকারী স্থানীয় এনজিও আরশিনগর বাংলাদেশকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শো-কজ) দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।

মঙ্গলবার (৫ ফেব্রুয়ারি) পিডি স্বাক্ষরিত নোটিশের একটি চিঠি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা প্রোগ্রাম অফিসারের দফতরে পৌঁছে।

জানা গেছে, নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধিনে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প চালু করে সরকার।

লালমনিরহাটের আদিতমারী ও হাতীবান্ধা উপজেলায় তিনশ’ করে ৬শ’টি কেন্দ্রে এ কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় আদিতমারী উপজেলায় ওন ভিলেজ অ্যাডভান্সমেন্ট (ওভা) এবং হাতীবান্ধা উপজেলার দায়িত্ব পায় আরশিনগর বাংলাদেশ।  

প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ৩০ জন পুরুষ ও ৩০ জন নারী পৃথক সময়ে শিক্ষার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। এসব কেন্দ্রে একজন পুরুষ ও একজন নারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের সুপারভাইজ করতে সুপারভাইজার ও প্রোগ্রাম অফিসারও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা উপকরণ ও কেন্দ্রের ব্যয় নির্বাহ করতে এনজিওকে বরাদ্দ দেয় সরকার।

জেলার দুই উপজেলার মধ্যে আদিতমারী উপজেলার ৩শ’টি কেন্দ্রে বিকেলে নারী ও সন্ধ্যায় পুরুষ শিক্ষার্থীরা পাঠদান শুরু হলেও হাতীবান্ধা উপজেলায় দেড় মাসেও শুরু হয়নি এ শিক্ষা কার্যক্রম।  

হাতীবান্ধা উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থার বিরুদ্ধে শুরু থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছে স্থানীয়রা। শিক্ষক নিয়োগের সময় ৬শ’ জন চাকরিপ্রত্যাশীর কাছে ঘুষ নিয়ে অনেককেই চাকরি দিতে পারেনি এনজিও আরশীনগরের নির্বাহী পরিচালক (এমডি) বাদশা আলম। ঘুষ দিয়েও চাকরি না পেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প অফিসে এমডিকে অবরুদ্ধ করে রাখেন চাকরিপ্রত্যাশীরা।  

সরেজমিন হাতীবান্ধা উপজেলার কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ কলমে শিখন শুরু হলেও বাস্তবে অনেক কেন্দ্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোথাও প্রকল্পের সাইনবোর্ড থাকলেও তা রয়েছে শিক্ষকের বাড়ির রান্না ও মুরগি রাখার ঘরে। কেউ কেউ গরুর গোয়াল ঘরে নাম সর্বস্ব সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছেন। প্রকল্প ঘোষিত দেড় মাস অতিবাহিত হলেও অনেক কেন্দ্রে শিক্ষা উপকরণও পৌঁছেনি। গ্রামবাসী এখনও জানেন না সরকার নিরক্ষরদের শিখনের জন্য এ সুযোগ করেছেন। বাস্তবায়নকারী সংস্থা ভুয়া কেন্দ্র ও ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগে এনজিও আরশিনগর বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক বাদশা আলমকে শো-কজ করেছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।

হাতীবান্ধা উপজেলার সিংগিমারী ইউনিয়নের ঠাণ্ডা আজিজের বাড়িতে কেন্দ্রের সাইনবোর্ড দেখা যায় রান্না ঘরে।  

ওই বাড়ির মালিক উম্মে তহুরা শিল্পী বাংলানিউজকে জানান, এখনও ক্লাশ শুরু হয়নি তাই এই ঘরেই রান্না করা হচ্ছে। ওই কেন্দ্রের শিক্ষক তার ছেলে তরিকুল ইসলাম। বিকেলে পুরুষদের পড়ানোর কথা থাকলেও ক্লাস সময়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

একই এলাকার কমলার বাড়ি কেন্দ্রেও কোনো ঘর নেই। সাইনবোর্ডসহ কিছু শিক্ষা উপকরণ ঘরে বস্তাবন্দি করে রাখা হয়েছে। আলিমের ডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ক্লিনিকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে কোনো কেন্দ্রের অস্তিত্ব না থাকলেও কাগজ কলমে দুই কেন্দ্রে ১২০ জন শিক্ষার্থী ও চারজন শিক্ষক দেখানো হয়েছে।

ওই এলাকার শাহিনুর রহমান ও নুরনবী বাংলানিউজকে জানান, নিরক্ষরদের শিখনের এমন সুযোগের কোনো খবর তাদের জানা নেই। এমন হলে এলাকার নিরক্ষর নারী পুরুষরা অক্ষরজ্ঞান পেত বলে দাবি করেন তারা।

প্রকল্পের হাতীবান্ধা প্রেগ্রাম অফিসার রাশেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, শিক্ষা উপকরণের জন্য এনজিও আরশিনগরের অনুকূলে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনেক উপকরণ সরবরাহ করা হয়নি। যা দিয়েছে তাও নিম্নমানের। এনজিওটির এমন সব অনিয়মের তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন চেয়ে প্রকল্প পরিচালক চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

আরশিনগর বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক বাদশা আলম এনজিওর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন উল্লেখ্য করে বলেন, শিক্ষক নিয়োগে এনজিওর কোনো হাত ছিলো না। স্থানীয় প্রশাসন আমাকে সহযোগিতা করছে না এবং স্থানীয় কিছু সমস্যার কারণে আমি সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছি না।  

উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের পরিচালক আব্দুর রহমান মোবাইলে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছি। ওই এনজিওকে কারণ দর্শানোর নেটিশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই এনজিওর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে মামলা দায়ের করা হবে।  

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বাংলানিউজকে জানান, মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এনজিও আরশিনগর বাংলাদেশ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় না করে নানা অনিয়ম করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।