এদিন সকাল ৭.১৫ মিনিটে এয়ার অ্যারাবিয়া’র G9-517 বিমানে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন সুমি। একই সঙ্গে সৌদি থেকে দেশে ফিরছেন নির্যাতিত আরও ৯১ নারী গৃহকর্মী।
সুমির আগমন প্রসঙ্গে তার স্বামী নুরুল ইসলামও বাংলানিউজকে একই কথা জানান। তিনি বলেন, সুমি শুক্রবার সকালে বাংলাদেশে ফিরবে। গত দুই-তিন দিন ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না।
ব্র্যাকের শরিফুল হাসান বলেন, সম্প্রতি সৌদির শ্রম আদালত সে দেশ ছাড়ার ব্যাপারে সুমির পক্ষে রায় দেন। ফলে তাকে তার নিয়োগকর্তার (কফিল) দাবি করা টাকা দিতে হবে না।
ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানান, সুমি শুক্রবার সকালে ঢাকায় পৌঁছাবেন। সৌদি আদালতের আদেশে দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করা ২২ হাজার সৌদি রিয়েল তিনি এখনই পাচ্ছেন না। এটা একটা অনগোয়িং প্রসেস। তাকে আপাতত দেশে পাঠানো হচ্ছে। পরে আইনকানুন দেখে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই ফ্লাইটে আরও ১০০ নারী সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছেন বলে জানান গোলাম মসিহ।
রাষ্ট্রদূত জানান, গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ নারী শ্রমিক সৌদি আরবে গেছেন। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার দেশে ফিরেছেন। ফিরে যাওয়া নারীশ্রমিকদের হার অনেক কম। সবাই যে নির্যাতনের কারণে ফিরে গেছেন, তাও নয়। তবে কিছু কিছু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আগামীতে এরকম অভিযোগ পেলে দূতাবাস সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে বলে অঙ্গীকার করেন তিনি।
চলতি বছরের ৩০ মে রিক্রুটিং এজেন্সি ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’র মাধ্যমে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস (এসভি) ৮০৫ যোগে সৌদি আরব যান আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের স্ত্রী সুমি। সেখানে যাওয়ার পর নিয়োগকর্তা (কফিল) ও অন্যদের পাশবিক নির্যাতনের মুখে পড়েন তিনি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওবার্তায় কান্নায় ভেঙে পড়ে দেশে ফেরার আকুতি জানান সৌদি প্রবাসী সুমি।
ওই ভিডিওতে সুমি বলেন, ‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইবো, আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়া যান। আর কিছু দিন থাকলে আমি মরে যাবো। ’
সুমির পরিবার জানায়, ২০১৬ সালে সুমি আক্তারকে বিয়ে করেন নুরুল ইসলাম। সুমি পঞ্চগড় জেলার বোদা সদর থানার রফিকুল ইসলামের মেয়ে। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সতীনের সঙ্গে সংসার শুরু করেন তিনি। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তানও হয়। কিন্তু সতীনের বিভিন্ন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ও সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্নে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমি।
এ উদ্দেশ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারিতে গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ শেষ করেন সুমি। তাকে বিনামূল্যে সৌদি পাঠানোর লোভ দেখায় দালালেরা। শেষমেশ মে মাসে সৌদিতে পাড়ি জমান নিম্নবিত্ত ঘরের এ গৃহবধূ।
কিন্তু বিদেশে পাঠানোর কথা বলে দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে সে কথা জানতেন না সুমি। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় মারধর, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন নির্যাতন। পরে ফেসবুকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিভিন্ন পাশবিক নির্যাতনের কথা বলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান সুমি। পরবর্তীতে ওই ভিডিওটি ভাইরাল হলে বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। পরে তাকে উদ্ধার করে সৌদি পুলিশ।
কিন্তু তার পরও সুমির দেশে ফেরা নিয়ে আইনি জটিলতা দেখা দেয়। তার নিয়োগকর্তা অর্থের বিনিময়ে তাকে ‘কিনে’ নেওয়ার দাবি জানান, এবং সৌদি আরব থেকে তার বের হওয়ার অনুমতি (এক্সিট) দিতে ২২ হাজার রিয়াল ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। পরে গত রোববার (১০ নভেম্বর) সৌদির নাজরান শহরের শ্রম আদালতে এ বিষয়ক এক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে কনস্যুলেট’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুমিকে দেশ ছাড়ার ‘ফাইনাল এক্সিট’ দেওয়ার দাবি মঞ্জুর করেন শ্রম আদালত। একই সঙ্গে আদালত সুমির নিয়োগবাবদ তার নিয়োগকর্তার দাবি করা ২২ হাজার সৌদি রিয়েল পরিশোধের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
এর আগে ৫ নভেম্বর জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল সুমিকে দেশে ফেরাতে রিক্রুটিং এজেন্সি ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’কে বিমানের টিকিটসহ ২২ হাজার রিয়াল (প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) দেওয়ার নির্দেশ দিতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেন।
সুমির স্বামী নুরুল ইসলাম জানান, সৌদি আরবে যাওয়ার পর সুমিকে এক বাড়িতে গৃহকর্মীর চাকরি দেওয়া হয়। তবে বাড়ির মালিক তাকে ঠিক মতো খেতে দিত না। বিভিন্ন সময় শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। দেশে পরিবারের সঙ্গেও তাকে কথা বলতে দেওয়া হতো না। নির্যাতনের শিকার সুমি বর্তমানে ঠিক মতো দেখতে পান না। তার হাতে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ঘটনা শোনার পর সুমিকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য তার স্বামী বাদী হয়ে তাকে সৌদিতে পাঠানো রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠান ‘রূপসী বাংলা এজেন্সি’র মালিক আক্তার হোসেনের নামে পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
ব্রাকের শরিফুল হাসানসৌদি আরবে একের পর এক নারী গৃহকর্মী নির্যাতিত হওয়ায় আগামীতে গৃহশ্রমিক হিসেবে সেখানে নারীদের না পাঠিয়ে নার্স, পোশাকশ্রমিক বা অন্য কোনো পেশায় তাদের পাঠানোর পরামর্শ দেন।
২০১৪ সালের জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত ৭৪টি দেশে বাংলাদেশের আট লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩ জন নারীকর্মী গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে তিন লাখ ৩০ হাজার ৫৯০, জর্ডানে এক লাখ ৫৩ হাজার ২৯১, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক লাখ ২৬ হাজার ১৪৩, লেবাননে এক লাখ ছয় হাজার ৪৪৪, ওমানে ৮৫ হাজার ৯১৪, কাতারে ৩২ হাজার ২৮০ ও মরিশাসে গেছেন ১৮ হাজার ৩৩১ জন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
জিসিজি/এইচজে