সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকাল থেকে খুলনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আগের দিন রোববার (১৭ নভেম্বর) থেকে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে যশোরেও।
বাংলানিউজের সিনিয়র, স্টাফ ও ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টদের পাঠানো খবর:
খুলনা থেকে সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাহবুবুর রহমান মুন্না জানিয়েছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে সকাল থেকে খুলনার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা।
পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলছেন, দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্যসহ সড়ক আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন চান চালকরা। তাদের দাবি, আইন সংশোধনের পরই এটি কার্যকর করা হোক। এটা না করা পর্যন্ত তাদের এ কর্মসূচি চলবে।
বিষয়টি নিয়ে ২১ ও ২২ নভেম্বর বর্ধিত সভা ডেকেছে শ্রমিক ফেডারেশন। ওই সভার এজেন্ডাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে আছে সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
এদিকে, খুলনা থেকে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো যাত্রী।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম বেবী বাংলানিউজকে বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালাচ্ছেন না। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
খুলনা জেলা বাস মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, শ্রমিকরা ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডের ভয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই তারা এসব করছে।
এদিকে, ভোরে ঈগল পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের বাস মহানগরীর রয়্যাল কাউন্টার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে সকাল ৯টার পর থেকে সব বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সাতক্ষীরা থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট শেখ তানজির আহমেদ জানিয়েছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে এ জেলার শ্রমিকরাও বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা চান, আগে আইনটি সংশোধন করে বাস্তবায়ন করা হোক।
জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিলে মালিকপক্ষের তো কিছুই করার থাকে না।
মাগুরা থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জয়ন্ত জোয়ার্দার জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে চালকের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান পরিবর্তনের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন সাধারণ শ্রমিকরা।
মাগুরা জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইমদাদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আইন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের আশ্বাস না পেলে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকরা।
এদিকে, মাগুরা-যশোর সড়কে বাস ধর্মঘটের কারণে যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। বিশেষ করে এ ধর্মঘটের ফলে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা।
কলেজছাত্র ইমন মিয়া ও চাকরিজীবী আকরাম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তাদের প্রতিদিন যশোর-মাগুরা যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু মাগুরা থেকে যশোরের বাস ভাড়া ৬০ টাকা হলেও এখন ১শ; থেকে দেড়শ’ টাকা দিয়ে ইজিবাইক, টেম্পু ও সিএনজিতে করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে অর্থ ও সময় উভয় বেশি লাগছে।
এদিকে, মাগুরা-যশোর সড়কে বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও মহাসড়কে ঢাকামুখী পরিবহন ও জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
যশোর থেকে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট উত্তম ঘোষ জানিয়েছেন, সড়ক আইন ২০১৮ প্রত্যাহার দাবিতে যশোরের ১৮ রুটে রোববার (১৮ নভেম্বর) থেকে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। উপায় না পেয়ে এ অঞ্চলের যাত্রীরা যাতায়াত করছেন ট্রেনে। দু’দিনই যশোর রেলস্টেশনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
শ্রমিক নেতাদের দাবি, শাস্তির খড়গ নিয়ে রাস্তায় নামতে চাইছেন না শ্রমিকরা। এজন্য স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। আর বৈধ কাগজপত্রের চালকরা বলছেন, অবৈধ কাগজপত্রের চালকরা মাঠে নামতে পারছে না। তাই শ্রমিক নেতাদের ইন্ধনে তারা ধর্মঘট পালন করছে।
জানা যায়, যশোর অঞ্চলের ১৮ রুটে স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করেন পরিবহন শ্রমিকরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো মানুষ। সকাল থেকে বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা কয়েকটি পরিবহন আটকে দেন শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা। বৈধ কাগজপত্রের চালকরা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে চাইলেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
ওইসব গাড়ির চালকদের দাবি, শ্রমিক নেতারা শ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে জিম্মি করছেন। এজন্য বৈধ কাগজপত্র থাকলেও অনেক চালক নামতে পারছেন না।
ট্রেন ও শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে একাধিক যাত্রী বলেন, ঘোষণা ছাড়াই পরিবহন ধর্মঘট চলছে। অথচ কেউ দায় নিচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া উচিত নয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকলে রাস্তার নামার দরকার নেই। কিন্তু যাদের বৈধ কাগজপত্র আছে, তারা কেন গাড়ি বন্ধ রাখবে? তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হোক।
রোববার দিনভর এ অচলাবস্থার পর রাতে যশোর কোতোয়ালি থানায় শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঘণ্টাব্যাপী ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন সোমবার পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানালেও শ্রমিকদের অবস্থান পরিষ্কার হয়নি সারাদিন।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক সমিতির সভাপতি মামুনূর রশীদ বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, ৯০ শতাংশ চালক রাস্তায় নামছে না। ফলে বাকি ১০ শতাংশ চালক বিবেকের তাড়নায় মাঠে নামেনি। সবাই স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি পালন করছে। যদি কেউ অভিযোগ করে, সেটি সঠিক নয়। শ্রমিকদের কর্মবিরতি মালিক ও শ্রমিকদের কোনো সংগঠন ডাকেনি। ফাঁসির দড়ি সামনে নিয়ে শ্রমিকরা পরিবহনে কাজ করতে রাজি নয়। তাই তারা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করেছে। এটা কোনো ইউনিয়ন বা ফেডারেশনের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি নয়। পরিবহন শ্রমিকরা ইচ্ছামতো কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
যশোরের পুলিশ সুপার মঈনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, রোববার রাতে বৈঠকে শ্রমিক নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন সোমবার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু এখানে শ্রমিক কিংবা বাসমালিক সংগঠন নয়, শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না শ্রমিক সংগঠনগুলো। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কঠোর হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছি।
চুয়াডাঙ্গা থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জিসান আহমেদ জানান, সড়ক আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গাতেও যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সোমবার (১৮ নভেম্বর) দুপুর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধ করে দেন তারা। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ ও দূরপাল্লার যাত্রীরা।
চুয়াডাঙ্গা জেলা বাস-ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এম জেনারেল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমিকরা কাউকে ইচ্ছা করে হত্যা করে না। অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য নতুন সড়ক আইনে তাদের ঘাতক বলা হচ্ছে। নতুন আইনের অনেক ধারার ব্যাপারে শ্রমিকদের আপত্তি রয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সংশোধন করতে হবে। সরকার সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে।
ঝিনাইদহ থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট এম রবিউল ইসলাম রবি জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সংশোধনের দাবিতে সকাল থেকে ঝিনাইদহের সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন শ্রমিকরা।
ঝিনাইদহ থেকে যশোরমুখী ইদ্রিস আলী নামে এক যাত্রী বাংলানিউজকে বলেন, ভিসার আবেদন করার জন্য আমাকে যশোর যেতে হবে। কিন্তু বাস পাচ্ছি না।
মোহাম্মদ শাহ আলম মিয়া নামে আরেক যাত্রী বলেন, সরকার একটি আইন করেছে। আর বাস মালিক ও শ্রমিকরা সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে বসে আছেন। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে আমাদের।
বাসচালকরা বলছেন, নতুন যে আইন করা হয়েছে, তাতে চালকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। দুর্ঘটনাতো দুর্ঘটনা। কেউতো এটা ইচ্ছা করে ঘটান না। আমাদের যদি পাঁচ লাখ টাকাই থাকবে, তাহলে আমরা গাড়ি চালাতাম না। আর তাই দ্রুত নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবি করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৯/আপডেট ২০২৭ ঘণ্টা
আরআইএস/এইচএ/