ওই সময় তারা পুরো গ্রামের ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সেই ভয়াল দিনে বেঁচে যাওয়া অনেকেই এখন মানবেতর দিন যাপন করছেন এবং শহীদদের মর্যাদা পাওয়ার দাদিও পরিবারগুলোর।
সেই দিন শীতের কাকডাকা ভোরে পুরো গ্রামটি ঘিরে হানাদার বাহিনী এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর নারকীয় হতাযজ্ঞ শুরু করে। প্রথমে তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর তেরশ্রী এস্ট্রেটের জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীর শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্যদেরও একই কায়দায় হত্যা করে ও পুরো গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
হানাদাররা চলে যাওয়ার পর আশপাশের গ্রামের লোকজন এসে মৃত দেহগুলো নিয়ে স্থানীয় শ্মশানে ও কবরস্থানে মাটি চাপা দেয়। এলাকাবাসীর দাবির মুখে ৪১ বছর পর শহীদদের স্মরণে তেরশ্রী গ্রামে নির্মিত হয় সরকারিভাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সেই স্তম্ভে ৩৬ জন শহীদের নাম লিপিবদ্ধ হলেও বাকীদের নাম অজানাই রয়ে গেছে। প্রতি বছর এই দিনে এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা শহীদদের স্মরণে নানা কর্মসূচী পালন করে। সেই সময়ের ভয়াল স্মৃতি নিয়ে তেরশ্রী গ্রামে এখনও বেঁচে আছে অনেকেই। তবে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে জমিদার পরিবারের সদস্যদের।
তেরশ্রী এস্টেটের জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরীর পুত্র স্কুল শিক্ষক সমেশ্বর রায় চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তেরশ্রী এস্ট্রেটের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় প্রসাদ চৌধুরী ছিলেন আমার বাবা। সেদিন আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে পাকহানাদার বাহিনীরা জীবন্ত হত্যা করেছে। আমার মা শীতের মধ্যে পুকুরের কচুরী পানার পানিতে কোনো রকম নাক মুখ বের করে নিজেকে রক্ষা করেছিল। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল অন্য গ্রামে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ভাবে আমরা শহীদ পরিবার গুলো কোনো স্বীকৃতি পাইনি। আমার সন্তানরা আমাকে প্রশ্ন করে আমার দাদু শহীদ হয়েছে সেই স্বীকৃতিটা কোথায়?
শহীদ পরিবারের সদস্য মধুসদর দত্ত বাংলানিউজকে বলেন,পাকহানাদার বাহিনী আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গাছের সাথে বেধে রেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে । ওই সময় আমরা ভাই বোন সবাই খুব ছোট। মা গর্ভাবস্থায় শত কষ্ট সহ্য করেও আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করতেন। যুদ্ধের পর টানা ১০টি বছর আমরা দু’বেলা খেতে পাই নাই। কিভাবে যে কেটেছে সেই দিনগুলি তা বলার ভাষা নেই। কিন্ত স্বাধীনতার আজ কত বছর পেরিয়ে গেলেও কেউ কোনো দিনের জন্য আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়লো না। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো দূরের কথা এক মুঠো চালও কেউ আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখেনি।
ঘিওর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ২২ নভেম্বর ভোর রাতে প্রায় ৩’শ পাকহানাদার বাহিনীর সাথে এদেশীয় রাজাকার আলবদররা মিলে তেরশ্রী গ্রামসহ আশপাশের চারটি গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করা হয় নিরিহ ৪৩ জন মানুষকে। শহীদের স্মুতি রক্ষার্থে একটি স্মুতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে এখানকার মানুষের দাবি মুক্তিযোদ্ধা ভিত্তিক একটা জাদুঘর এবং পাঠাগারের। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সে উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০২২৩ ঘন্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
এমএমএস