ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘দাতাদের টাকা শ্রমিকদের হাতে পৌঁছায়নি’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৯
‘দাতাদের টাকা শ্রমিকদের হাতে পৌঁছায়নি’ তাজরীন ট্র্যাজেডি মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন সারোয়ার হোসেন। ছবি: বাংলানিউজ

সাভার (ঢাকা): ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সাত বছর আগে এ দিনটিতে ঘটে গিয়েছিল দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ওই দিন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৩ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়, আহত হন আরও তিন শতাধিক শ্রমিক।

সেই ভয়ানক ঘটনার পুরোটাই নিজের চোখে দেখেছেন ও উদ্ধারকাজে সহায়তা করেছিলেন শ্রমিক নেতা সারোয়ার হোসেন। বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেদিনের সেই ভয়ানক পরিস্থিতির কথা।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের সাভার করেসপন্ডেন্ট সাগর ফরাজী।  

বাংলানিউজ: সেই ভয়াবহ সন্ধ্যায় তাজরীনে গিয়ে কী দেখেন?
সারোয়ার হোসেন: আমিসহ কয়েকজন শ্রমিক প্রতিনিধি সেখানে গিয়ে দেখি কারখানার ভেতর থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ আসছে। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজন রাস্তার পাশে পানির পাইপ নিয়ে দৌঁড়াদৌড়ি করছে। কেউ আবার আগুনে দগ্ধদের কারখানা থেকে বের করছে। আমিও কোনো কিছু না ভেবে কারখানার ভেতরে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারে কাজ শুরু করি। একসময় জীবিত শ্রমিকদের বের করতে করতে পোড়া মরদেহ বেরিয়ে আসে। মরদেহগুলো কোনোরকম ধরে কারখানার পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। এগুলো দেখে হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল, নড়াচড়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। মানুষপোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল।

বাংলানিউজ: রানা প্লাজা ও তাজরীন ট্র্যাজেডি আমাদের পোশাক খাতে শোকাবহ দুই ঘটনা। তাজরীনের দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আপনি। পোশাক খাতে এই দুর্ঘটনার প্রভাবকে কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
সারোয়ার হোসেন: তাজরীনে আগুন লাগার ঘটনাটি ছিল সন্ধ্যায়। তখন সাভার-আশুলিয়ার প্রায় সব কারখানায় ছুটি হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে উৎসুক জনতার ভিড় হয়েছিল বেশি। ঘটনার একদিন পরেই ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের স্বজনরা কারখানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। এছাড়া আশুলিয়া অঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলোতেও একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এখানে পোশাক খাতে প্রভাবের কথা বললে আমি বলবো- রানা প্লাজা ও তাজরীন ট্রাজেডির পরে দেশের পোশাক খাতে আইন-কানুনের অনেক উন্নতি হয়েছে। এককথায় বলা চলে, শ্রমিকদের বলি দিয়ে দিয়ে দেশের পোশাক খাতে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এখন শ্রমিকরা কিছুটা হলেও ন্যায্য অধিকার পায়।

জ্বলছে তাজরীন ফ্যাশন।  ফাইল ফটো

বাংলানিউজ: বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নিহত শ্রমিকের স্বজন ও আহতরা বলছেন এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাদের এ দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত?
সারোয়ার হোসেন: আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কোনো ব্যক্তির অবহেলার কারণে যদি কারও মৃত্যু হয়, এর দায়ভার তাকেই নিতে হবে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও মানবিকতার দিক থেকে দেখলে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। কারণ যখন আগুন লাগে কারখানার কিছু কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি অগ্নিমহড়া, কোথাও আগুন লাগেনি। তাদের কথা শুনে শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে গেছে। কিন্তু, আগুন শ্রমিকদের কাজের জায়গায় প্রবেশের পর তারা কারখানা থেকে বের হওয়ার জন্য ছোটাছুটি করলেও অনেকেই বের হতে পারেনি। কারণ, কারখানার প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ থেকেই বলা যায়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

বাংলানিউজ: নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহতরা কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছে?
সারোয়ার হোসেন: তাজরীনে আগুন লাগার ঘটনার সাত বছর হয়ে গেছে। নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহতদের জন্য আমরা আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। কিন্তু, তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ আজ অব্দি দেওয়া হয়নি। সরকার ও বিজিএমইএ (বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) বলছে, অনেক পরিবারকেই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। অনেকেই এখনো চিকিৎসার অভাবে চলতে পারছে না। আবার অনেক শ্রমিক যে সহায়তা পেয়েছে তা ক্ষতিপূরণ নয়, নিতান্তই কিছু সংগঠনের দেওয়া অনুদান। এই ঘটনায় যে ক্ষতি হয়েছে, এখানে বাংলাদেশ সরকার, বিজিএমইএ ও পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে আরও ভালো ভূমিকা রাখা উচিত। তারা চাইলে এখনও সেটা করতে পারে।

পুড়ে ছাই গার্মেন্টসের ভেতরের যন্ত্রপাতি।  ফাইল ফটো

বাংলানিউজ: তাজরীনের আগুনে নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহতদের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা এসেছিল। এ সহায়তার টাকা কিছু শ্রমিক নেতা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সারোয়ার হোসেন: এটি একেবারেই সত্যি ঘটনা। কারণ, আমরা এই আর্থিক দিকটাকে সহায়তা বা অনুদান যা-ই বলি, এখানে সমন্বয়ের অভাব ছিল। কয়েকটি দাতা সংস্থা নির্দিষ্ট কিছু শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে এ কাজটি করেছে। সংস্থাগুলো ভুক্তভোগীদের সহায়তার জন্য স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের হাতে টাকা দিলেও তা আর শ্রমিকদের হাতে পৌঁছায়নি। আবার কেউ কেউ যে টাকা সহায়তা পাওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশিও পেয়েছে। এটা আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলোর জন্য অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এর জন্য শ্রমিকরা আমাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।

বাংলানিউজ: নভেম্বর আসলেই তাজরীন ট্র্যাজেডি নিয়ে নানা আলোচনা হয়, দাবি-দাওয়া ওঠে। বাকি ১১ মাস আপনাদের নিশ্চুপ দেখা যায় কেন?
সারোয়ার হোসেন: আমরা যারা শ্রমিক সংগঠনে রয়েছি, তারা কখনোই এর দায় এড়াতে পারি না। কারণ, আমরা প্রথমে যেভাবে সম্মিলিতভাবে তাজরীনে নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহতদের নিয়ে কাজ করেছি, সেটি এখন আর নেই। বর্তমানে কেউই সারা বছর এদের খোঁজ-খবর রাখি না, শুধু ২৪ নভেম্বর এলেই বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, ফুল দিয়ে নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানাই। এটি সংগঠন ও নিজেদেরই ফোকাস করার জন্য করা হয়। এই একটা দিন আসলে আমরা ব্যানার করে নানা দাবি জানাই, আর সারা বছর ভুক্তভোগীদের কোনো খবর রাখি না। তাই আমি বলবো, আমাদের শ্রমিকরা এখন জ্বালানির উপকরণ হয়েছে। পোশাক খাতে শ্রমিকদের ব্যবহার করে অনেকে অনেক কিছু করেছেন। মধ্যখানে বলি হচ্ছে শুধু শ্রমিকরা। আর তাজরীনের সেই শ্রমিকরা আজকের এই দিনে জ্বালানির উপকরণ হয়েছিল। আমাদের উচিত ভালো মানসিকতা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো।

শ্রমিক নেতা সারোয়ার হোসেন।  ছবি: বাংলানিউজ

বাংলানিউজ: তাজরীনের আগুনের ঘটনায় মামলার বিচারকাজ কতদূর?
সারোয়ার হোসেন: সাত বছর ধরে মামলা চলছে। এর চার্জশিট বের হয়ে গেছে। মামলার প্রধান আসামি দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতার হয়েছিলেন, পরে জামিনে বের হয়ে আসেন। তাজরীনে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের এখনো শাস্তি নিশ্চিত হয়নি। বিভিন্ন সময় বলা হচ্ছে, এ মামলায় সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলবো, এটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বাঁচানোর একটি কৌশল। তাই এ মামলায় জড়িতদের দ্রুত বিচার করতে হবে। এতে নিহত শ্রমিকদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সারোয়ার হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলানিউজকে ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৯
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।